সুদীর্ঘকাল পূর্বপাকিস্তানে কলকাতার সংবাদপত্রের প্রবেশ নিষিদ্ধ। যুগান্তরের চীফ রিপোর্টার অনিল ভট্টাচার্যই প্রথম সেকথা পাড়লেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন মিঃ আলি, ঢাকা যেয়েই এই সম্পর্কে খোঁজখবর করবেন। দমদম ত্যাগ করে ঢাকা যাবার জন্য আবার বিমানের দিকে রওনা হলেন। বিমানে চড়বার আগে সব রিপোর্টারদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। সিঁড়ি দিয়ে বিমানে উঠে গিয়ে অনুরোধ করলেন, দমদমে গৃহীত ফটোগুলির কপিগুলো যেত তাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সম্মতি জানালেন তারক দাস ও অন্যান্য ফটোগ্রাফারের দল।
পরদিনের প্রভাতী সংবাদপত্রগুলির প্রথম ও প্রধান সংবাদরূপে দমদমে মহম্মদ আলির সঙ্গে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারের বিবরণী ছাপা হল। রিপোর্টারদের সঙ্গে তার ছবিও বেরুল। ঢাকা সফরের খবরও নিত্য বেশ ভালভাবেই বেরুতে লাগল। ঢাকা থেকে করাচী উড়ে যাবার পথে আবার দমদম আসবেন বলেও খবর ছাপা হল। এবার একটু বেলাতেই মিঃ আলির প্লেন দমদম এলো। দমদমের কিছু উৎসাহী লোকেরও জমায়েত হয়েছিল। প্রটেকটেড, এরিয়া থেকে বেরিয়ে ভিআইপি রুমে যাচ্ছেন মিঃ আলি! পাশে ভীড়ের মধ্যে থেকে একটা আধা ময়লা হাফসাট পায়জামা পরা এক ছোঁকরা এগিয়ে
কাকা, কাকাবাবু, ছেলেটি ডাকল।
মিঃ আলি পিছন ফিরলেন। ছেলেটি সোজাসুজি সামনে এলো। চিনতে পারেননি। মিঃ আলি। ছেলেটিই উৎসাহী হয়ে নিজের কাকার নাম করল। বগুড়া বাসিন্দা। হৃদ্যতা ছিল এই দুজনের মধ্যে। ফেলে আসা দিনের বন্ধুর খোঁজখবর করলেন। জানলেন, বন্ধু এখন উদ্বাস্তু ক্যাম্পের বাসিন্দা। ক্রটি করলেন না সংসারের আরো পাঁচজনের কুশলবার্তা নিতে। ছেলেটিকে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়ে আদর করলেন। করাচীতে চিঠি লিখতেও বল্লেন। গদীর গুণে সারল্য বিসর্জন দেননি মহম্মদ আলি। দেখে সবাই খুশি।
দলবল নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘরে ঢুকলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আতিথেয়তা রক্ষার জন্য। এক গেলাস অরেঞ্জ স্কোয়াস হাতে নিয়ে সেই চেনা মোটা শোলার হাট পরে ডিফেন্স সেক্রেটারি ইস্কান্দার মীর্জা বাইরে বেরিয়ে এলেন। দেশ বিভাগের আগে থেকেই দেশরক্ষা দপ্তরের উচ্চপদে বহাল ছিলেন মিঃ মীর্জা। লম্বা চওড়া চেহারা। মুখোনা বিশালকায়। স্যার আশুতোষকে রয়াল বেঙ্গল টাইগার বলা হত। মীর্জাকে বল্লেও অন্যায় বা অত্যুক্তি হবে না কোন দিক থেকেই। বারান্দার একপাশে সরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্য আলাপ আলোচনা করলাম। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে দেরী হল না, মিঃ মীর্জা একজন জাঁদরেল অফিসার। এর কাছে কেন জানি না মহম্মদ আলিকে যেন অসহায় মনে হল। পশুরাজ সিংহের সঙ্গে নেংটি ইঁদুরের খেলা নিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে গল্প আছে। আশঙ্কা হল ভবিষ্যতে পাকিস্তানের ইতিহাসে মীর্জা-আলি নিয়েও বোধ হয় এমনি গল্প আবার লেখা হবে।
আমাদের কৃষ্ণমেননের মতন স্বদেশী সাংবাদিক দেখলে ভ্রু কুঞ্চিত করেন না মিঃ আলি। প্রেস সাইনেসের বালাই নেই মহম্মদ আলির। এবারও রিপোর্টারদের কাছে এক লম্বা-চওড়া বিবৃতি দিলেন আগের দিনের সুরে। নির্দিষ্ট সময় বিশ্রাম করে সুইস-মেড ছাতিটাকে স্পোর্টস্ স্টিকের মতন ঘুরতে ঘুরতে প্লেনের দিকে চল্লেন। সিঁড়ি দিয়ে দুএক ধাপ উপরে উঠতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। আমরা সব কাছেই ছিলাম। আমাদের আগের দিনের আশঙ্কার মূলে কুঠারাঘাত করবার জন্য হাতের ছাতিটাকে দেখিয়ে বল্লেন :
জেন্টলম্যান অফ দি প্রেস! নেভার মাইণ্ড, দিস ইজ নট অ্যান আমেরিকান রাইফেল, যাস্ট অ্যান অর্ডিনারি আমব্রেলা।
উপস্থিত সকলের মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে নিজে হাসতে হাসতে বিদায় নিলেন মহম্মদ আলি।
উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলার প্রায় মাঝখান দিয়ে করতোয়া নদী বয়ে গেছে। করতোয়ার পশ্চিমে শেলবর্ষ পরগণার কুন্দগ্রামের জমিদার ছিলেন নবাব আবদুল সোহবান চৌধুরী। নবাবনন্দিনী আলতাফান্নেসার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নবাব আলি চৌধুরীর। রাষ্ট্র সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে এককালে বাংলাদেশের মন্ত্রিত্ব করেছেন এই নবাব আলি চৌধুরী। এদেরই পুত্র হলেন মহম্মদ আলির পিতৃদেব নবাব জাদা আলতাফ আলি চৌধুরী। এক ময়মনসিংহ দুহিতার সঙ্গে আলতাফ আলির প্রথম বিয়ে হয়। তারই গর্ভের পাঁচটি পুত্রের প্রথমটি হলেন মহম্মদ আলি। আলতাফ আলি মহম্মদ আলির গর্ভধারিণীকে তালাক দিয়ে পরে সাগর পারের এক কটা সুন্দরীর পানিগ্রহণ করেন। পূর্বাতন আলতাফ বেগমও মালা জপ করে জীবনের অবশিষ্টাংশ কাটাননি। তিনিও এক ব্যারিস্টারের সঙ্গে নিকায় বসেছিলেন এখন সে মহিলা ধরালোক ত্যাগ করেছিলেন। সাধারণভাবে ভদ্র বিনয়ী থাকলেও, আলতাফ আলি শনিবারের বারবেলায় বা রবিবারের প্রাক-গোধূলিতে খিদিরপুরের ঘোড় দৌড়ের মাঠের সঙ্গে গাঁটছড়া না বেঁধে থাকতে পারেননি। লক্ষ লক্ষ টাকা ঘোড়ার খুরের ধূলায় উড়িয়েছেন। সন্ধ্যার স্তিমিত আলোকে হস্তান্তরের দলিলে দস্তখতের সাথে সাথে কলকাতার বহু বাড়ি চৌধুরী পরিবারের হাতছাড়া হয়েছে। স্নো হর্স অ্যাণ্ড ফাঃ উমেনের কৃপায় মৃত্যুকালে লক্ষাধিক টাকা দেন। রেখে গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। সম্ভবতঃ আরো পাঁচজন ধনীর মত সে অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। আলতাফ আলির ফিরিঙ্গি পত্নীর গর্ভের প্রথম সন্তান হলেন ওমর আলি। লেস বসানো জরি-আঁটা লক্ষ্ণৌ চিকনের পাঞ্জাবী পরে কানে আতর গুঁজে সন্ধ্যায় তানপুরা হতে নিয়ে বসতেন ওমর আলি। পরে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন কিছুকাল। আরো পরে, নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতা মহম্মদ আলি যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তখন সুরাবদীর পক্ষে ভ্রাতৃ বিদ্বেষ প্রচার করে পাক-রাজনীতিতে খ্যাতি অর্জন করেন।