এখনও এক সপ্তাহ হয়নি। করাচী রেলস্টেশনে নিয়মিত যাত্রীদের আগমন-নির্গমন সেদিনের মত শেষ হয়েছে। ভোরের আগে আর কোন বাষ্পীয় শকটের আবির্ভাব হবার কথা নয় করাচী স্টেশনে। হঠাৎ মধ্য-রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে একটা ট্রেন স্টেশন প্লাটফর্মে প্রবেশ করল। অভ্যাস মত কুলিরা সব ঘুম থেকে চট করে উঠে বসল। মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পারল, এটা কোন সাধারণ যাত্রীগাড়ি নয়। আবার তারা সব গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। প্লাটফর্মে গাড়ি থামল। কর্তাব্যক্তিদের ত্বরিত গতিতে এদিকে ওদিকে ছুটাছুটি! সান্ত্রীদের উপস্থিতি। প্লাটফর্ম লাল কার্পেটে মুড়ে দেওয়া হল। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দীন যাবেন লাহোর না রাওয়ালপিণ্ডি। তাঁরই শুভাগমন প্রত্যাশায় স্টেশন প্লাটফর্মে রেল আর পুলিশের কর্তারা সব ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে করে অপলক নেত্রে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কয়েক মিনিট বাদেই টেলিফোনের আওয়াজ। তারপর আবার কর্তাদের মন্থর গতিতে এদিক-ওদিক যাওয়া-আসা। সামনের, লাল আলো নীল হল। নির্দিষ্ট যাত্রীকে না নিয়েই ট্রেনটা স্টেশন পরিত্যাগ করল। সান্ত্রীরা তাদের অস্ত্রাদি ঘাড়ে করে শিথিল পদক্ষেপে ফিরে গেল। পোটারের দল এগিয়ে এলো। লাল কার্পেট গুটিয়ে রাখা হল। করাচী স্টেশন আবার ঝিমিয়ে পড়ল।
সারা শহরটাও তখন নিস্ত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে শুধু আরব সাগর পারের করাচী বন্দর থেকে আত্মীয়-বন্ধুহীন প্রত্ত নাবিকদের চীৎকার শোনা যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় তরণীর নাবিকদেরও সে রাত্রে ঘুন হয়নি। সারা রাত্রি চলেছিল শলা-পরামর্শ আর মন্ত্রণা। ব্যর্থতার দোহাই দিয়ে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে মুক্তি দিলেন নাজিমুদ্দীন সাহেবকে। আর সেই সোনালী সিংহাসনে বসালেন মহম্মদ আলিকে এই রাত্রিতেই।
দেশ বিভাগের প্রাক্কালে কিছুকালের জন্য মহম্মদ আলি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেশ কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিলেন। অবিভক্ত বাংলার শেষ প্রধানমন্ত্রী সুরাবর্দীর ঐতিহাসিক রাজত্বকালে সাময়িক ভাবে অর্থমন্ত্রীর পদে মহম্মদ আলি নিযুক্ত হয়েছিলেন। সে কারণে কলকাতার রিপোর্টার মহলের সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। মধ্যরাত্রির অনেক পরে খবর পেয়েও ভোর পাঁচটায় দমদম বিমানবন্দরে কার্পণ্য হয়নি রিপোর্টারদের উপস্থিতিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি, আর পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনের জনকয়েক কর্তাব্যক্তি কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পাদনের জন্য হাজির ছিলেন। আর বিশেষ কেউ ছিলেন না। ভোরের আলো তখন সবে ছড়িয়ে পড়লেও, সূর্যরশ্মি তখনও ঠিকরে পড়েনি দমদমের লম্বা রানওয়েতে। ঠিক সময় বি-ও-এ-সি বিমানটি এসে পৌঁছাল। বিমানের দরজা খুলতেই ভিতর থেকে এয়ার হোস্টেস্ ইঙ্গিত করে জানালেন, বিমানে ভি. আই. পি. (Very Important Person) রয়েছেন। নিম্ন কর্মচারীর পরিবর্তে পদস্থ কর্মচারীরাই অধিকতর উৎসাহী হয়ে বিমানে সিঁড়ি লাগালেন। সহাস্য বদনে নেহরুজীর মত এক ব্যাটন হাতে বেরিয়ে এলেন মিঃ আলি।
বিমান থেকে নেমে আলি সাহেব দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে ভি-আই পি রুমে প্রবেশ করলেন। পিছন পিছন এলেন প্রধানমন্ত্রীর একজন ব্যক্তিগত কর্মচারী। তরুণ বাঙ্গালী যুবক। আগে রাইটার্স বিল্ডিংএ স্টেনোগ্রাফার ছিলেন। আর এলেন খাকি প্যান্ট ও মোটা শোলার হাট পরে পাকিস্তান সরকারের দেশরক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি মিঃ ইস্কান্দার মীর্জা। মিঃ মীর্জা আর ঘরে ঢুকলেন না। বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। উপস্থিত অফিসারদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলেন।
ঘরের ভিতর মিঃ আলির সোফার চারিদিকে বসে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা রিপোর্টারের দল। একজন প্রৌঢ় বাঙ্গালীকে প্রধানমন্ত্রীরূপে পেয়ে রিপোর্টারদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। প্রধানমন্ত্রী হয়েও মহম্মদ আলির মুখের হাসিকে অহেতুক গাম্ভীর্য গ্রাস করেনি। দেখে সবাই আনন্দিত। স্টেটম্যান পত্রিকার চীফ রিপোর্টারের দিকে ফরে বল্লেন, হাউ আর ইউ, মিঃ দাশগুপ্তা? পিছন দিকে ঘাড় ফিরিয়ে অমৃতবাজারের যতীনদার (মুখার্জী) দিকে লক্ষ্য করে তার কুশলবার্তা জানতে চাইলেন। কলকাতার স্মৃতি রোমন্থন করে জিজ্ঞেস করলেন, এর-ওর কথা। কাগজের অফিসের নানানজনের কথা। রাইটার্স বিল্ডিংসএর টুকিটাকি। ডাঃ রায়ের সংবাদ। তারপর শুরু হল কাজের কথা; বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী আমাদের জানালেন, ভারত-পাকিস্তানের মৈত্রী বন্ধন কোনদিন কোনো কারণেই শিথিল হতে পারে না। বরং সে বন্ধন দৃঢ়তর হবে। নেহরুজীকে নিজের জ্যেষ্ঠভ্রাতার মতন শ্রদ্ধা করেন জানিয়ে নিকট-ভবিষ্যতে কাশ্মীর ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনার জন্য তার সঙ্গে মিলিত হবার অভিপ্রায়ও মিঃ আলি জানান।
আমেরিকায় পাকরাষ্ট্রদূত ছিলেন মিঃ আলি। রাষ্ট্রদূত পদ থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী। ঘোড়ার থেকে সহিস না হলেও, অনুরূপ একটা কিছু বটে। আইসেনহাওয়ার প্রভুদের কোন হাত নেই তো এই পরিবর্তনে। আমেরিকা মহম্মদ আলিকে দিয়ে কোন বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করবে নাতো? সেদিন আরো পাঁচজনের সাথে সাথে কলকাতার রিপোর্টারদের কাছেও এ সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। লজ্জা, ঘৃণা, ভয় থাকলে যেমন তান্ত্রিক সাধনা সম্ভব নয়, তেমনি আজকের দিনে খবরের কাগজের রিপোর্টার হওয়াও অসম্ভব। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করেই প্রশ্ন করা হল। Is it not hut natural that the United States would enjoy some special favour during our Prime Ministership? সব সন্দেহ ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। সরাসরি এ আশঙ্কা অমূলক বল্লেন। এমন দরদ দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বল্লেন যে, তা অবিশ্বাস্য মনে হল।