হায়দ্রাবাদ, মহীশূর, জম্মু-কাশ্মীর বা বরোদার মত ভূপাল খুব বড় দেশীয় রাজ্য ছিল না। তবে মধ্য ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলির মধ্যে ভূপালের গুরুত্ব ও প্রভাব ছিল যথেষ্ট। মোগল সম্রাট বাহাদুর শার রাজত্বকালে দোস্ত মহম্মদ নামে অতিলোভী আফগান চাকরি-বাকরি জোগাড়ের চেষ্টায় দিল্লীতে আসেন ও পরবর্তীকালে ভূপাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে ইনি মালবার বারসিয়া পরগণার ইজারা লাভ করেন এবং মালবার রাজার মৃত্যুর পর অরাজকতার সুযোগে ভূপাল ও তার সংলগ্ন কিছু এলাকায় নিজের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পিণ্ডারীর যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকার ভূপালের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন এবং ভূপালের অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীকালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিও ভূপালের অখণ্ডতা রক্ষা করে। ১৮৪৪ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত তিন বেগম এই রাজ্য শাসন করেন। এরপর ভূপালের গদীতে বসেন স্যার হামিদুল্লা খান।
স্যার হামিদুল্লা এগারো লাখ টাকা রাজন্য ভাতা পেতেন। এই টাকার দশ লাখ পেতেন নবাব নিজে এবং এক লাখ পেতেন তার বড় মেয়ে। এই বড় মেয়েই ছিলেন নবাবের আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারিনী। এই রাজ্য ভাতা ছাড়াও নবাবের বহু নিজস্ব সম্পত্তি ছিল নানা জায়গায়। অন্যান্য অনেক দেশীয় রাজাদের মত ভূপালের নবাবের বেশ কিছু ধনসম্পত্তি ছিল বিদেশী ব্যাঙ্কে। বোধ হয় বিদেশে বেশ কিছু ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিল এবং ভারত সরকারকে না জানিয়েই এ সব ব্যবসা-বাণিজ্য চলছিল।
যাই হোক মৃত নবাবের দ্বিতীয় কন্যা ভূপালে গিয়ে হৈ চৈ শুরু করে দিলেন। উনি অনেকের মনেই এমন ধারণা সৃষ্টি করলেন যে, ভূপালের গদী উনিই পাবেন এবং অনেকের কাছ থেকে টাকাকড়ি নিয়ে স্ফুর্তি শুরু করলেন। পন্থজীর কানে এ খবর পৌঁছাতেই উনি গোয়েন্দা দপ্তর ও মধ্যপ্রদেশ সরকারকে বললেন; নবাব-নন্দিনীর বন্ধুদের জানিয়ে দাও যে একজন পাকিস্তানীকে টাকাকড়ি দিয়ে সাহায্য করলে ভারত সরকার অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হবেন।
ভূপাল রাজকোষ থেকে টাকা নেবার অধিকার তাঁর ছিল না; সরকারী হুমকীতে ভয়ে বন্ধুরাও টাকা দেয়া বন্ধ করলেন। মহা মুশকিলে পড়লেন নবাব-নন্দিনী। বার বার টেলিফোন করেন দিল্লী, কিন্তু পন্থজীর ব্যস্ততার জন্য কিছুতেই তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান না। এদিকে ভিসার মেয়াদ প্রায় শেষ। আবার ট্রাংকল করেন দিল্লীতে; না, পন্থজী এখন কথা বলতে পারবেন না। ক্যাবিনেট মিটিং চলছে।
নবাব-নন্দিনীর ভারতবাসের শেষ দিন উপস্থিত। মধ্য রাত্রেই ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। আবার ট্রাংকল দিল্লীতে। হ্যাঁ, এবার পন্থজীকে পাওয়া গেল। নবাব-নন্দিনী কিছু বলার আগেই পন্থজী গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেন কদিন এত ব্যস্ত ছিলাম যে আপনি বার বার টেলিফোন করা সত্ত্বেও আমি কথা বলতে পারিনি। যাই হোক, বলুন কেমন আছেন? ভূপালে কেমন দিন কাটাচ্ছেন। নিশ্চয়ই খুব আনন্দে। নবাব-নন্দিনী বললেন, দিনগুলো ভালই কাটছে কিন্তু আজ রাত্রেই যে আমার ভিসার মেয়াদ শেষ।
পন্থজী চমকে উঠে বলেন, সে কি! আগে বলেননি কেন? আপনার ভিসার মেয়াদ অনায়াসে বাড়িয়ে দেয়া যেত।
কিন্তু আপনার সঙ্গে যে কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারলাম মা।
আপনি দিল্লী চলে এলেন না কেন?
সেটা আমার ভুল হয়েছে।
কিন্তু এখন কি করবেন? ভূপাল থেকে তো করাচীর কোন প্লেন নেই। আপনাকে তো বোম্বে বা দিল্লী হয়ে যেতে হবে।
ভিসার মেয়াদ বাড়ানো যায় না?
যায়, কিন্তু আজ অফিস ছুটি হবার আগে কি আপনি দিল্লী পৌঁছতে পারবেন?
না, সে অসম্ভব।
খুবই দুঃখের কথা যে আজ মাঝ রাত্তিরের মধ্যেই আপনাকে ইণ্ডিয়া ছাড়তে হবে।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পন্থজী ওকে কয়েক ঘণ্টা বিলম্বে ভারত ত্যাগের বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা করে দিলেন এবং নবাব-নন্দিনী পরের দিন বোম্বে থেকে করাচী চলে গেলেন।
নবাবের বড় মেয়ে পতৌদীর বেগম আবার তাঁর ছোট্ট সাদা গাড়িটা চড়ে ছ নম্বর মৌলানা আজাদ রোডে এলেন। নিজের স্বপক্ষে পন্থজীকে অনেক কিছু বললেন।
পন্থজী বললেন, শুনেছি বিদেশের নানা ব্যাঙ্কে নবাবের বেশ কিছু টাকাকড়ি ও মূল্যবান গহনাপত্র আছে-এটা কি ঠিক?
কিছু আছে বৈকি?
কিন্তু সরকারের বিনা অনুমতিতে বিদেশী ব্যাঙ্কে কিছু রাখা তো বে-আইনী।
হ্যাঁ, তা তো জানি।
আপনি কি জানেন কোথায় কি আছে? নবাবের সব সম্পত্তির সঠিক হিসাবনিকাশ পেলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে আর সময় লাগবে না।
পন্থজীর কথার অর্থ বোঝেন পতৌদীর বেগম। উনি বললেন, হ্যাঁ, কিছু কিছু খবর জানি বৈকি এবং এ সব সম্পত্তির ওপর আমার কোন দাবী নেই। বেগমসাহেবা একটু ভেবে বললেন, তবে আমার ছেলে মনসুর আলি খান বিলেতে পড়ছে। তার পড়াশুনার জন্য….
পন্থজী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, আপনার ছেলের পড়াশুনার খরচের জন্য যে ফরেন এক্সচেঞ্জ দরকার, তার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করা হবে।
ঐ টাকা বাদ দিয়ে বিদেশী ব্যাঙ্কের সব টাকা ও বিদেশের নানা কোম্পানিতে নবাব যে সব টাকা লগ্নী করেছিলেন, তার অধিকার ভারত সরকার গ্রহণ করার পরই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরকারী বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হল, পরলোকগত নবাবের বড় মেয়ে পতৌদীর বেগমই ভূপালের গদী পাবেন।
এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন পন্থজী। দিল্লীতে এসেই টাইপরাইটার খট খট করে এক দীর্ঘ রিপোর্ট তৈরি করলাম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাগজের অফিসে পাঠালাম না। মনে মনে ভাবলাম, পন্থজী যখন আমাকে এত স্নেহ করেন, তখন এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ খবর তাকে না জানিয়ে ছাপা উচিত নয়।