সন্ধ্যায় অফিসে গিয়েই চীফ রিপোর্টারকে সব জানালাম কিন্তু উনি কোন মন্তব্য করলেন না। বোধহয় আমাকে ভাল করে বকুনি দেবার সুযোগ না পেয়ে মনে মনে একটু আহত হলেন।
ইংরেজি দৈনিকের ঐ রিপোর্টারের বিষয়ে দুচার কথা বলা প্রয়োজন। ওঁর শ্বশুরমশায়ের প্রতিষ্ঠানে আমি এক কালে শিক্ষানবিশী সাংবাদিক ছিলাম বলে উনি মনে মনে আমাকেও ওঁর অধঃস্তন কর্মচারী ভাবতেন এবং আমাদের মত ছেলেদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা উনি সম্মানজনক মনে করতেন না। উনি অবশ্য শ্বশুরমশায়ের দৌলতেই সাংবাদিক হন। ওঁর শ্বশুরমশায়ের প্রতিষ্ঠানটি সরকারের পাওনা লক্ষ লক্ষ টাকা না দিয়েই লালবাতি জ্বালান। কোন কর্মচারী প্রফিডেন্ট ফাণ্ডের একটি পয়সাও পান না। শুনেছি, এই প্রতিষ্ঠানের একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক বহুদিনের মাইনে ও প্রফিডেন্ট ফাণ্ডের টাকাকড়ি না পাওয়ায় অভাবের তাড়নায় শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যাও করেন। তবু এরা সমাজে বিখ্যাত ও শ্রদ্ধেয়।
যাইহোক সব মিলিয়ে চৌ এন লাইএর এই সফর আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম অধ্যায়ের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। পরে দিল্লীতে আবার চৌ এন লাইএর দেখা পেয়েছিলাম। ধীর, স্থির, বিচক্ষণ দেশনায়ক হিসেবে চৌ এন লাইকে আমি চিরকাল মনে রাখব।
০৮. মনে রাখব জুলফিকার আলি ভুট্টোকে
প্রায় পুরোপুরি বিপরীত কারণেই মনে রাখব জুলফিকার আলি ভুট্টোকে। সিন্ধু প্রদেশের লারকানার কোটিপতি জমিদার স্যার শাহনাওয়াজ ভুট্টোর এই ছেলেটি মরিয়াও প্রমাণ করিল, সে মরেন নাই। স্যার শাহনাওয়াজ শুধু জমিদার ছিলেন না, তিনি বম্বে ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ও কিছুকাল মন্ত্রীও ছিলেন। জুলফি তখন মহানন্দে দিন কাটাচ্ছেন বোম্বেতে। খেলার সাথী স্যার হোমি মোদীর ছেলে পিলু। আলালের ঘরের দুলাল হলেও জুলফি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হবার পর অক্সফোর্ড থেকে এম. এ. পাশ করে লিঙ্কন-ইন থেকে ব্যারিস্টার হলেন। কিছুকাল বিলেতে অধ্যাপনা করার পর অধ্যাপনা আর ব্যারিস্টারী করার জন্য দেশে ফিরলেন। কিছুদিনের মধ্যেই আয়ুব পাকিস্তানের তখৎ-এ-তাউস দখল করলেন। তারপর হঠাৎ একদিন জুলফি তাঁর বাণিজ্য মন্ত্রী হলেন। তখন উনি সত্যি যুবক। বয়স তিরিশের ঘরের একেবারে প্রথম দিকে। দেখতে না দেখতে জুলফিকার আলি ভুট্টো আয়ুবের দক্ষিণহস্ত ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হলেন। এই সময়ই ভুট্টোকে আমি কয়েকবার দেখি। সর্দার শরণ সিং ভুট্টোর বার বার কথা হয় ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ মীমাংসার চেষ্টায় কিন্তু ওঁর কথাবার্তা শুনে মনে হতো, এমন ভারত-বিদ্ধেষী আর জন্মাবেন না। এমন অনর্গলভাবে ভারতের সবকিছুর নিন্দা করতে আর কারুর কাছে কখনও শুনিনি। মনে হয়েছিল, ওর জিহ্বায় দুষ্টু সরস্বতী বিরাজমানা। তবে হ্যাঁ, প্রখর বুদ্ধিমান ছিলেন এবং জলপ্রপাতের ধারার মত সুন্দর ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন। সর্বোপরি ছিলেন মহা অহঙ্কারী। হাজার হোক ধনী ও বিখ্যাত জমিদারের ছেলে। দেখতে সুপুরুষ ও উচ্চশিক্ষিত। তার উপর অল্পবয়সে রাজনৈতিক খ্যাতি ও ক্ষমতা লাভ করে উনি বড় অহঙ্কারী হয়ে পড়েন। এবং প্রতিটি কথায় তা প্রকাশ হয়ে পড়ত।
প্রথমে বন্দী ও পরে কঁসিতে মৃত্যুর পরে এখন অনেকেই জুলফিকার আলি ভুট্টোর প্রতি সমবেদনশীল হয়েছেন এবং মনুরে দিক থেকে তা স্বাভাবিক ও কাম্য। তবু ইতিহাস-প্রেমিক ভুট্টোকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিচার করলে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের জন্য ভুট্টো ব্যক্তিগতভাবে অনেকাংশে দায়ী। সর্বোপরি বাংলাদেশে বাঙালী নিধনযজ্ঞের অন্যতম হোতাও ছিলেন এই ভুট্টো। যে কারণে নাদির শাকে কোনদিনই শ্রদ্ধা করব না, ঠিক সেই কারণেই আমি পিলু মোদর এই বাল্য বন্ধুকেও চিরকাল ঘৃণা করব। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের সব অতীত কুকীতি মুছে ফেলা যায় না। পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য এইরকম খামখেয়ালী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতাদের উপর বার বার দেশ শাসনের ভার পড়েছে।
পাকিস্তানের জনক মহম্মদ আলি জিয়ার সঙ্গে মোলকাত করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে বইপত্তর পড়ে তার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে না পারলেও মানুষ জিন্নার প্রতি নিশ্চয়ই শ্রদ্ধাশীল হয়েছি। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানকে একবারই দেখেছি। কয়েকবার দেখেছি ও সামান্য আলাপ-পরিচয় হয়েছিল পাকিস্তানের পরবর্তী এক প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ আলির (বগুড়া) সঙ্গে। এই মহম্মদ আলিকে নিয়েই আমার লেখক জীবনের প্রথম লেখা লিখি (রিপোর্টারের ডায়েরী : ভারতবর্ষ : পৌষ, ১৩৬৪) চৈত ছদ্মনামে।
মধ্যরাত্রির কিছু পরেই টেলিপ্রিন্টারে এক ফ্লাস মেসেজ এলো।
…Pakistans newly appointed Prime Minister, Mr. Mohammad Ali will pass through Calcutta early this morning on his way from Karachi to Dacca.
ইংরেজি মতে তখন ক্যালেণ্ডারের তারিখ বদলেছে। আর্লি দিস মর্নিং বলতে রাত একটা না দুটো, তিনটা না চারটে, তার কোন ইঙ্গিত নেই ক্লাসমেসেজে। কোন্ বিমানে তাঁর আগমন, তারও কোন হদিশ নেই এই সংক্ষিপ্ত খবরে। মাত্র কদিন আগে নিতান্ত নাটকীয় ভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে মহম্মদ আলি নিযুক্ত হয়েছেন। লিয়াকত আলি খানের আকস্মিক মৃত্যুর পর ঢাকার মসনদ ত্যাগ করে করাচীর তখৎ-এ-তাউস অলঙ্কত করে জব নাজিমুদ্দীন একদিন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করলেও সেটা অচিন্তনীয় কিছু হয়নি। কিন্তু প্রৌঢ় বয়স্ক নবীন রাজনীতিবিদ মহম্মদ আলির পক্ষে মার্কিন মুলুকে দূত হওয়াই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হলেও, অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁকে প্রধান মন্ত্রীপদে নিয়োগে সারা দেশে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সুতরাং দমদম বিমান বন্দরে সেই সৌভাগ্য চূড়ামণির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের লোভ কলকাতার সাংবাদিকরা কর্তব্য ও আগ্রহের আতিশয্যে সম্বরণ করতে পারেননি। নাইট ডিউটির সব রিপোর্টাররা এখানে-ওখানে-সেখানে টেলিফোন করলেন। নানান মহলে খোঁজ-খবর করে জানলেন, প্রত্যুষে পাঁচটা নাগাদ বি-৪-এ-সি-বিমানে তার আগমন হচ্ছে দমদমে। বিমান ও বিমানযাত্রীরা প্রাতরাশ শেষ করে যাবেন ঢাকা।