আমি তখন ফ্রীলান্স রিপোর্টার হলেও প্রধানতঃ কলকাতার এক বিখ্যাত দৈনিকের সঙ্গে যুক্ত। চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সারা দেশ ঘোরা কথা তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারি না কিন্তু এত বড় ঐতিহাসিক সফরে কোন এক অংশও কভার করব না, তাও মেনে নিতে পারি না। চিঠি লিখলাম চীনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আর. কে. নেহরুকে। উনি খবর পাঠালেন, চীনা প্রধানমন্ত্রীর সফর শুরু হবার কয়েক দিন আগে কলকাতা হয়েই দিল্লী পৌঁছব। তুমি হাকসারের বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করো।
এখানে একটু অন্য প্রসঙ্গে আসা দরকার। ডক্টর কৈলাশনাথ কাটজু যখন পশ্চিম বাংলার রাজ্যপাল, তখন একদিন রাজভবনের এক অনুষ্ঠানেই ওঁর বড় মেয়ে শ্রীমতী সুভদ্রা হাকসারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এবং প্রথম দর্শনেই তাকে মাতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে শুরু করি। রামকৃষ্ণ-মার একনিষ্ঠ সাধিকা শ্ৰীমতী হাকার কয়েক দিনের মধ্যেই আমার মাতাজী হয়ে গেলেন এবং উনিও বিন্দুমাত্র বিধা না করে আমাকে সন্তানের স্নেহ করতে শুরু করলেন। মিঃ হাকসার তখন ডানলপের ডিরেক্টার ও ওঁরা তখন গুরুসদয় দত্ত রোডে থাকতেন এবং সেখানে আমার নিত্য যাতায়াত ছিল। মিঃ হাসারের বোনের সঙ্গেই মিঃ আর. কে. নেহরুর বিয়ে হয়েছিল। এই হাকসার পরিবারের দৌলতেই আর. কে. নেহরুর সঙ্গে আমার বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে ওঠে এবং উনিও আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার জীবনের চরম দুর্দিনে মাতাজীর স্নেহ-ভালবাসার কথা আমি জীবনেও ভুলব না।
যাইহোক হাকসার-গৃহে মিঃ নেহরুর সঙ্গে কথাবার্তা হবার পর উনি বললেন, তুমি চিত্তরঞ্জন-সিন্ধী ছাড়াও কলকাতায় প্রাইম মিনিস্টারের সফর কভার করো এবং আমি তার ব্যবস্থা করব। ফ্রীলান্স রিপোর্টার হিসেবে সরকারী প্রেস কার্ড ছিল এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রচার অধিকর্তা প্রকাশ স্বরূপ মাথুরের সৌজন্যে চীনা প্রধানমন্ত্রীর সফর কভার করার বিশেষ প্রেস কার্ডও পেয়ে গেলাম। যে সংবাদপত্রের জন্য প্রধানতঃ কাজ করতাম, তাদের কাছে চৌ এন লাইএর চিত্তরঞ্জন সিন্ধী সফর কভার করার প্রস্তাব করতেই ওঁরা সরাসরি প্রস্তাবটি বাতিল করে দিলেন। আনন্দবাজার-হিন্দুস্থান স্টাণ্ডার্ডের চীফ রিপোর্টার মণীন্দ্র ভট্টাচার্য বললেন, আমরা চিত্তরঞ্জনে কোন রিপোর্টার পাঠাচ্ছি না। হ্যাঁ, তুমি চিত্তরঞ্জন ট্যুর কভার করে এবং তার জন্য আমরা তোমাকে একশ টাকা দেব। ব্যস! আমাকে তখন কে দেখে!
যাইহোক কদিন ধরে চৌ এন লাইএর সঙ্গে ঘোরাঘুরি করে দেখলাম, উনি বড় সিরিয়াস প্রকৃতির মানুষ। সবকিছুই গভীরভাবে বিচার-বিবেচনা করা ওঁর সহজাত স্বভাব। সর্বোপরি উনি পরিপূর্ণ ভাবে রাজনীতিবিদ (a total political personality)। মনে পড়ে কলকাতা রাজভবনের কাউন্সিল চেম্বারে ওঁর সাংবাদিক সম্মেলনের কথা। চৌ এন লাই চেয়ারে বসতে না বসতেই একজন মার্কিন সাংবাদিক একটা প্রশ্ন করলেন। চৌ এন লাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনারা বড় বেশি উদ্ধত। সব সময় সব ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে ব্যস্ত। আমি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ভারত সফর করছি। সুতরাং আমি যে প্রথমে ভারতীয় সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেব, এটুকু সৌজন্যজ্ঞান আপনার থাকা উচিত।
এই একটি ছোট্ট সাধারণ উত্তরের মধ্য দিয়েই চৌ এন লাই মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির তীব্র সমালোচনা করলেন এবং এ ধরনের কথা শুধু -ওঁর পক্ষেই বলা সম্ভব ছিল।
এই সফরের শেষে আমার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন ভি-আই-পিদের সঙ্গে কলকাতার সাংবাদিকরা নিয়মিত ছবি তুলতেন। চৌ এন লাই ও মার্শাল হো লুঙ ১৯৫৬ সালের দশই ডিসেম্বর সকালে দমদম থেকে স্বদেশ রওনা হন। বিমানে ওঠার প্রাক্কালে কয়েকজন রিপোর্টার-ফটোগ্রাফার চৌ এন লাইকে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার আগ্রহ প্রকাশ করতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হলেন। আমি চীনা প্রধান মন্ত্রীর ঠিক পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম। এবং উনি আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরেই ছবি তুললেন। তখন আমি ফ্রীলান্স হলেও কলকাতার যে দৈনিকের জন্য আমি প্রধানতঃ কাজ করতাম, সেই অফিসে বিকেলবেলায় যেতেই অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন চীফ রিপোর্টার গর্জে উঠলেন–তুমি চৌ এন লাইএর হাত ধরে ছবি তুলেছ কেন? তোমার এই ফাজলামির জন্য পুলিশ ক্ষেপে লাল। এখন ঠেলা সামলাও।
কথাটা শুনেই আমি ঘাবড়ে গেলাম। তবু সাহস সঞ্চয় করে। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কে বলল?
উনি একটি ইংরেজি পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টারের নাম করে বললেন, ও পুলিশের একজন অফিসারের কাছে শুনেছে।
ঐ ভদ্রলোকের নাম শুনেই মনে হলো, উনি বোধহয় ঈর্ষায় আমার নামে মিথ্যা কথা বলছেন। তবু মনে মনে একটু শঙ্কিতই রইলাম।
পরের দিন সকালেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিরেক্টর অব পাবলিসিটি মিঃ মাথুরের কাছে গেলাম। উনি সব শুনেই বললেন, বাজে কথা। চাইনীজ প্রিমিয়ার যদি খুশি হয়ে তোমার হাত ধরে ছবি তোলেন, তাতে পুলিশের আপত্তি করার কী কারণ আছে? তাছাড়া আমাকে না জানিয়ে পুলিশ নিশ্চয়ই কিছু করবে না।
পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হবার জন্য চীফ সেক্রেটারি সত্যেন রায়ের কাছে গেলাম। উনি হেসে বললেন, ঐ রিপোর্টারটি নিছক ঈর্ষায় তোমার নামে মিথ্যে কথা বলেছে। তাছাড়া আমিও তো চাইনীজ প্রিমিয়ারে পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। যে ছবিতে আমি আছি, তার ব্যাপারে পুলিশ কী বলবে?