উনি আমার সঙ্গে করমর্দন করবার সময় বললেন, এবার কায়রো আসার আগে আমাকে জানাবেন।
নিশ্চয়ই জানাব।
***
ক্রশ্চভ-বুলগানিনের মতই অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা পেয়েছিলেন প্রথম ভারত সফরকারী মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক ও নাৎসী ফৌজের বিভীষিকা আইসেনহাওয়ারকে নিয়ে দিল্লীর মানুষ উন্মাদ হয়ে উঠেছিল। সত্তর বছরের এই যুব নেহরুর সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা গভীর আলাপ-আলোচনার পর রাষ্ট্রপতি ভবনের বাইরে এসেই অন্য মানুষ। স্কাউট ও গাইড কিশোরকিশোরীদের মধ্যে এসে তিনিও ওদেরই একজন হয়ে গেলেন। এই মানুষটিই ওয়েলেসলী রোডের ধারের গলফ ক্লাবের মাঠে নিছকই একজন পরম উৎসাহী খেলোয়াড়। প্রেস সেক্রেটারি জেমস্ হ্যাঁগাটি আমাদের বললেন, ছবি আঁকা, বই পড়া ও মাছ ধরার সময়ও উনি রাষ্ট্রপতি থাকেন না। তখন উনি অন্য জাতের মানুষ। সত্যি তাই। দিল্লীর উপকণ্ঠের এক গ্রামে গিয়ে আইসেনহাওয়ারও নিছক একজন গ্রামবাসীর মতই কথাবার্তা বলেন। গরু-বাছুর চাষ-বাসের ব্যাপারে ওঁর কথাবার্তা শুনে গ্রামের লোকজন অবাক।
প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারকে তাজমহল দেখাতে নিয়ে গেলেন স্বয়ং নেহরু। সঙ্গে আইসেনহাওয়ারের পুত্রবধু বারবারা আইসেন হাওয়ার। সঙ্গী সাংবাদিকদের মধ্যে আমিও আছি। তাজমহলের চারপাশে ঘুরে-ফিরে দেখে ওরা উপরে আসেন। পাশেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের অসংখ্য প্রশ্ন করেন আইসেনহাওয়ার। বারবারাকে বুঝিয়ে দেন নেহরু। ভাবপ্রবণ নেহরু তাজমহল দেখে যেন একটু আনমনা হয়ে যান। আমি ছোট্ট একটা সরস মন্তব্য করি। সাংবাদিক বন্ধুরা হেসে ওঠেন কিন্তু আমার মন্তব্য বোধহয় নেহরু শুনতে পান না। কিছু বলেনও না।
তাজমহল দেখে বিদায় নিচ্ছেন রাষ্ট্রপতি আইসেনহাওয়ার। ঐ একই ভোলা মোটরে বসে নেহরু। আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের ধন্যবাদ জানাবার পর হঠাৎ আইসেনহাওয়ার আমাকে ডেকে আমার সঙ্গে করমর্দন করেই হাসতে হাসতে বললেন, আমি তোমার মন্তব্য শুনে খুব উপভোগ করেছি।
ওঁর কথায় আশেপাশের সব সাংবাদিক বন্ধুরা হো হো করে হেসে ওঠেন। আর আমি অবাক হয়ে ভাবি, উনি তো আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে কথা ছিলেন। আমার মন্তব্য শুনলেন কী করে?
উনি যে আইসেনহাওয়ার! চতুর্দিকে এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না থাকলে কি বিশ্ববরেণ্য সেনাপতি হওয়া যায়?
সর্বনাশা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কটা বছর কাটতে না কাটতেই পৃথিবীর দুটি বিবাদমান শক্তির সাময়িক মোকাবিলা শুরু হলো এই এশিয়ারই এক দেশে–কোরিয়ায়। কবছর যুদ্ধ চলার পর চুক্তি হলে উত্তর কোরিয়া থেকে রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সৈন্য সরিয়ে নেবে। চুক্তি হলেই যে তা রক্ষা করতে হবে, এ কথা দুটি বিবাদমান শক্তি বিশ্বাস করে না এবং তাইতো উত্তর কোরিয়ার সৈন্যবাহিনী হানা দিল দক্ষিণ কোরিয়া। রাষ্ট্রপুঞ্জের সৈন্যবাহিনী প্রতিরোধ করল কিন্তু চীনের পিপলস্ ভলান্টিয়ার ফোর্স যুদ্ধ শুরু করল দক্ষিণ কোরিয়ায়। আরো কত কি ঘটল। শেষ পর্যন্ত কোরিয়ার রণাঙ্গনে যুদ্ধ থামল কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা নিয়ে নতুন করে লড়াই শুরু হলো ইন্দো-চীনে।
কোরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজে নেহরু ও কৃষ্ণ মেননের অবদান বিশ্ববাসী স্বীকার করলেও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব জন ফস্টার ডালেস গোষ্ঠী নিরপেক্ষ ভারতের এই গুরুত্ব মেনে নিতে পারলেন না। তাইতো তারই একগুয়েমির জন্য ইন্দো-চীন সংক্রান্ত জেনেভা সম্মেলনে ভারতকে আমন্ত্রণ জানান হলো না। সেটা ১৯৭৪ সালের মে মাসের কথা।
সম্মেলন শুরু হতে না হতেই দেখা দিল দ্বন্দ্ব। সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করে ডালেসের প্রতিনিধি হুমকি দিলেন নতুন সর্বাত্মক লড়াইয়ের। বৃটিশ প্রতিনিধি স্যার এ্যান্তনি ইডেন এক সম্মেলনকে চালু রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলেও কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। সম্মেলন প্রায় ভেঙে যায় আর কি! এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে রাষ্ট্রপুঞ্জে যাবার পথে টুরিস্ট হিসেবে নেহরুর দৃত কৃষ্ণ মেনন জেনেভায় হাজির।
জেনেভায় মেনন পৌঁছতে না পৌঁছতেই কয়েকটি পাশ্চাত্য দেশে শুরু হলো তার নিন্দা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেনেভা সম্মেলনে অনিমন্ত্রিত এই কৃষ্ণ মেননই অষ্ণতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলেন এবং বৃটেনের এ্যান্তনি ইডেন, রাশিয়ার মলোটভ, চীনের চৌ এন লাই, ভিয়েতনামের কাম ভন ভোঙ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানী, নরওয়ে, সুইডেন, কলম্বিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধিরা প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় মেননের সঙ্গে পরামর্শ করা শুরু করলেন। এই জেনেভা সম্মেলন শেষ পর্যন্ত সাফল্যমণ্ডিত হবার পিছনে মেননের অবদান পরবর্তী কালে সবাই স্বীকার করেন।
যাইহোক এই জেনেভা সম্মেলনের সময়ই চৌ এন লাইএর সঙ্গে মেননেব গভীর হৃদ্যত হয় এবং সেই সূত্র ধরেই দেশে ফেরার পথে দিল্লী হয়ে যাবার জন্য নেহরু চৌ এন লাইকে আমন্ত্রণ জানালেন। চৌ খুশি হয়েই সে আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দিল্লী এলেন। চৌ এন লাই এর সেই প্রথম ভারত ভ্রমণ। পরের বছর বান্দুংএ চৌ এন লাইএর সঙ্গে নেহরু এ মেননের আবার দেখা হল এবং তারপরের বছর (১৯৫৬) চৌ এন লাই তার ঐতিহাসিক ভারত সফরে এলেন।