যাই হোক বহু ইতিহাসের স্রষ্টা ও নবজাগ্রত এশিয়া-আফ্রিকার অন্যতম মহানায়ক নাঁসেরকে আবার দেখি ১৯৬২ সালের বেলগ্রেড গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সম্মেলনে ও পরে দিল্লীতে। দৈবক্রমে একটু ঘনিষ্ঠ হবারও দুর্লভ সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রনায়কেরই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। অনেকে বিরল প্রতিভাসম্পন্ন হন। কোন কোন রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে বিস্ময়কর দূরদর্শিতা থাকে কিন্তু অনেক রাষ্ট্রনায়কের মধ্যেই যা থাকে না, তা হচ্ছে উষ্ণ ব্যক্তিত্ব। ইংরেজিতে যাকে বলে warni personality. আমাদেব নেহরুর মধ্যে ছাড়াও এই বিরল গুণ দেখেছি নায়েব ও নক্ৰমার মধ্যে।
মনে পড়ে বেলগ্রেড গোষ্ঠী নিরপেক্ষ দেশগুলির শীর্ষ সম্মেলনে কটি দিনের কথা। এখনকার মত সরকারী খবচে কাল সাবাদিক নিয়ে নেহরু বিদেশ সফর করতেন না এবং করার প্রয়োজনও বোধ করতেন না। (পাশ্চাত্য দেশগুলিতে রেডিও টি. ভি-সংবাদপত্রের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা আছে বলে তারা জলের মত অর্থ ব্যয় করে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের বিদেশ সফর কভার করে। কমিউনিষ্ট দেশগুলিতে এই প্রতিযোগিতা বিন্দুমাত্রও নেই কিন্তু তবু কমিউনিষ্ট নেতারা নিজেদের ব্যাপক প্রচারের জন্য বিদেশ সফরের সময় বিমান ভর্তি রেডিও-টি. ভি-সংবাদপত্ৰ-সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকদের সঙ্গে আনেন। এখন এই রোগ গরীব দেশগুলির রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়েছে।) বেলগ্রেডে আমরা মাত্র তিন চারজন ভারতীয় সাংবাদিক ঐ ঐতিহাসিক সম্মেলনের খবর সংগ্রহের জন্য উপস্থিত ছিলাম এবং তার মধ্যে একজন ছিলেন অল ইণ্ডিয়া রেডিওর সংবাদদাতা মিঃ চোনা। একজন বৃদ্ধ সাংবাদিক সস্ত্রীক ইউরোপ পরিভ্রমণে বেরিয়ে এই সম্মেলনের সময় বেলগ্রেডে ছিলেন। একটি গুজরাতী দৈনিকের মালিকের পুত্র নিছক মজার জন্য সাংবাদিক হিসেবেও তখন এখানে ছিলেন। মোটকথা মিঃ চেনা ছাড়া আমরা দুজন সাংবাদিকই সংবাদ সংগ্রহ করে আমাদের সংবাদপত্রে পাঠাতাম। তাইতো আমাদের দুজনকে সর্বত্রই উপস্থিত থাকতে হতো।
বেলগ্রেডে আমার একটু বিশেষ সুযোগ সুবিধা ছিল। প্রধানমন্ত্রী নেহরু ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন। সদস্য ছিলেন কৃষ্ণ মেনন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ আর. কে. নেহরু, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জগন্নাথ খোসল ও আরো দুতিনজন। নেহরু, কৃষ্ণ মেনন ও আর. কে. নেহরু আমাকে স্নেহ করতেন বলে অনেক সময় ওদের সঙ্গেই নানা অনুষ্ঠানে যোগদান করতাম। এই রকম একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানেই কৃষ্ণ মেনন আমাকে নাসেরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। দুএকটি সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পরই উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এখানে (বেলগ্রেড) আসার পথে কী কায়রো গিয়েছিলেন?
না। আমি বেইরুট-এথেন্স হয়ে এসেছি
ইউ মাস্ট কাম টু কায়রো অন ইওর ওয়ে ব্যাক হোম।
নিশ্চয়ই আসব। আমারও কায়রো যাবার খুব ইচ্ছা।
নামের আমার কাঁধের উপর একটা হাত রেখে একটু হেসে বললেন, মাই ডিয়ার ইয়ং ফ্রেণ্ড, আমার দেশের মানুষ নেহরু ও মেননকে আমার চাইতেও বোধহয় বেশি ভালবাসে। তাই বলছি, কায়রো না এলে খুব অন্যায় করবেন।
নাসের হয়তো একটু অতিশয়োক্তি করেছিলেন কিন্তু বুঝলাম, মিশরের মানুষ নেহরু ও মেননকে সত্যি প্রিয়জন মনে করেন। নেহরুর সঙ্গে কায়রো সফরের সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু একবার মেনন যখন কায়রোতে ছিলেন, তখন আমিও সেখানে। একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার সময় মেনন আমাকে সঙ্গে নিলেন। অনুষ্ঠান শুরু হবার আগে দর্শকরা মেননকে দেখলে হৈ চৈ করবেন ও হলের সামনে অসম্ভব ভীড় জমবে বলে আমরা অনুষ্ঠান শুরু হবার বেশ কিছুক্ষণ পরেই হলে ঢুকলাম। ইন্টারভ্যালের সময় হঠাৎ কিছু দর্শক মেননকে দেখতে পেয়েই চিৎকার করে উঠলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের কী উল্লাস! না দেখলে সত্যি বিশ্বাস করা যায় না। গর্বে আনন্দে মন ভরে গেল। অনুমান করতে কষ্ট হল না নেহরুর জনপ্রিয়তা। যাই হোক মাস দেড়েক ইউরোপ ঘুরে দিল্লী ফেরার পথে কদিন কায়রোয় কাটিয়ে সত্যি আনন্দ পেয়েছিলাম।
কয়েক বছর পর নাসের দিল্লী এলে আবার দেখা। ওঁর আলীগড় সফরও কভার করলাম। দিল্লীতে ফিরে আবার দেখা। মাঝে মাঝে টুকটাক কথাবার্তা হয়।
এই সময় নাসেরের নামে এক বিচিত্র ও মুখরোচক গুজব ছড়ায় দিল্লীতে। দুএকটি পত্রপত্রিকায় তা ছাপাও হয় কিন্তু কেউই সাহস করে গুজবের সত্য-মিথ্যা যাচাই করছিলেন না। সাংবাদিক সম্মেলনে আমিই ওঁকে প্রশ্ন করলাম। পাশেই বসেছিলেন নেহরু। উনি আমার প্রশ্ন শুনেই রেগে লাল কিন্তু নাসের হাসি মুখেই জবাব দিলেন। ঐ প্রশ্নোত্তরের জন্যই জানা গেল গুজবটি মিথ্যা ও তার চিরসমাধি ঘটল। রাষ্ট্রপতি ভবনের রিসেপসনে নাসের আমাকে বললেন, আপনি সাহস করে ঐ প্রশ্নটি করেছিলেন বলেই আমি বলতে পারলাম, গুজবটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ওর কোন ভিত্তি নেই। আপনি প্রশ্ন না করলে গুজবটি আরো বহুজনের মধ্যে ছড়িয়ে অযথা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করত।
আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, আমিও ঠিক এই উদ্দেশ্যেই প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু প্রাইম মিনিস্টার আমাকে ভুল বুঝলেন।
আমি আপনাকে যা বললাম, তা মিঃ নেহরুকেও বলেছি।
থ্যাঙ্ক ইউ ইওর একসেলেন্সী।