কিন্তু সময় তো বিশেষ নেই।
তা হোক। তবু আমরা চেষ্টা করব।
শুধু মানুভাইএর বক্তৃতার প্রথম প্যারা না, চেয়ারম্যান ক্রশ্চভের নামে নতুন আমন্ত্রণ পত্রও ছাপা হলো। এবং শত শত অতিথিরা এই নতুন আমন্ত্রণলিপি নিয়েই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এলেন। মানুভাইএর বক্তৃতার প্রথম পাতাও নতুন করে ছাপা হয়ে এলো ঠিক সময়। এত অল্প সময়ের মধ্যে কিভাবেই যে এসব ছাপা হলো এবং শত শত অতিথিদের কাছে পৌঁছে গেল, তা ভেবে মানুভাই ও ভারতীয় দূতাবাসের সবাই বিস্মিত না হয়ে পারলেন না।
ক্রশ্চভ একলা না, রাষ্ট্রপতি মিকোয়ানও এলেন উদ্বোধন অনুষ্ঠানে। ভারত মেলার শেষ প্রান্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার পটভূমিকায় দার্জিলিং তৈরি করা হয়েছিল এবং সেখানে কয়েকটি ভারতীয় সুন্দরী দার্জিলিং এর চা পরিবেশন করছিল। ক্রশ্চভ ঐ সুন্দরীদের দেখেই হাসতে হাসতে বললেন, এদের যদি আগে দেখতাম, তাহলে কি আমি আমার স্ত্রীকে বিয়ে করতাম?
ওঁর কথায় সবাই হাসেন।
তারপর মিকোয়ানকে বলেন, মেয়েরা কেউ আপনাকে পছন্দ করবে না। ওরা আমাকেই চায়। আপনি দূরে দাঁড়ান।
এইসব হাসি-ঠাট্টা চলতে চলতেই ক্রশ্চভ হঠাৎ গী হয়ে মাভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তো আমাদের আরো চা বিক্রী করতে চান, তাই না?
ইয়েস ইওর একসেলেনসী!
কাল সকাল এগারটায় আমার সঙ্গে দেখা করবেন।
এই কথা বলেই ক্রশ্চভ চলে গেলেন।
সোভিয়েতে চা রপ্তানীর ব্যাপারে যত চিঠিপত্র ও কথাবার্তা হয়েছে, সে সম্পর্কে কাগজপত্র জোগাড় করার জন্য মস্কোর ভারতীয় দূতাবাস এবং দিল্লীর পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সারারাত টেলে মেসেজ লেনদেন হলো। মানুভাই ও অফিসাররা সারারাত ও সকাল সেসব নিয়ে পড়াশুনা ও আলাপ-আলোচনা করে যথাসময়ে, ক্রেমলিনে হাজির হলেন। সোভিয়েত পররাষ্ট্র বানিজ্য মন্ত্রণালয়ের সবাইও হাজির। ঠিক এগারটার সময় ক্রশ্চভ ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকেই বললেন, ভেরি বিজি, ভেরি বিজি। দুতিন মিনিট থেকেই আমি পালাব।
তারপর অন্য কিছু বলার আগেই ক্রশ্চভ গড় গড় করে বলে গেলেন, ভারত এই সময় এই সব প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা তার এইসব জবাব দিয়েছি। এখনই আমরা এত চা কিনব, পরে এত কিনব এবং ভারতকে এইসব ব্যবস্থা করতে হবে।
এইটুকু বলেই উনি আবার ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন।
এত বছরের কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে এক সপ্তাহ পরে দুই দেশের প্রতিনিধি দল দেখলেন, ক্রশ্চভ যা বলেছেন, তাই আদর্শ সমাধান এবং ক্রশভের প্রস্তাব অনুযায়ী দুই দেশের ধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো।
সে সময় সেই অসম্ভব ব্যস্ততা ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার মাঝে ক্রশ্চভ যে কিভাবে চায়ের ব্যাপারে এত খবর জানলেন, তা মানুভাই ভেবে পেলেন না।
ক্রশ্চভ সত্যি অনন্য পুরুষ ছিলেন।
০৭. গামাল আবদুল নাসের
আমি গামাল আবদুল নাসেরকে প্রথম দেখি কলকাতায়। বান্দুংএ অনুষ্ঠিত এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলির সম্মেলনের শেষে দেশে ফিরছিলেন। তখনও বোয়িং বা জাম্রো আবিষ্কার করা হয় নি। সুপার-কন্সস্টেলেশন ও ভাইকাউণ্ট বিমানই সর্বাধুনিক। এক লাফে পৃথিবীর এদিক থেকে, ওদিক উড়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না বলেই নেহুর, নাসের ও আফগানিস্তানের নিয়াম কলকাতায় যাত্রা বিরতি করেছিলেন এক রাত্রির জন্য। সেটা ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসের কথা।
বেশ মনে আছে বিকেলের দিকে ওঁরা দমদম পৌঁছলেন। বিমান থেকে প্রথম বেরুলেন নেহরু, তারপরই নাসের ও নিয়াম। মধ্যপ্রাচ্যের মহানায়ক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিরাট জিজ্ঞাসা নাসেরকে দেখেই রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। দীর্ঘকায় চেহারা, দোহারা গড়ন, মুখে হাসি। পরণে কর্নেলের পোক। সঁইত্রিশ বছরের এই অনন্য রাষ্ট্রনায়ককে নবজীবনের দূত মনে করত বিশ্বের অসংখ্য মানুষ। করবে না কেন? মাত্র চৌত্রিশ বছরের যে তরুণ ইংরেজের পোয্যপুত্র ব্যাভিচারী ফারুককে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে পারেন, তাকে নবযুগের স্রষ্টা মনে করাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে পঞ্চাশের দশকে জন্ম নিল পৃথিবীর তৃতীয় শক্তি ( Third world ) এবং নেহরু, সোয়েকৰ্ণ, টিটো, বন্দরনায়ক, উ, নক্রমার মত এই তরুণ রাষ্ট্রনায়কও তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম মহানায়ক। তাইতো সেদিন অস্তগামী সূর্যের আলোয় দমদম বিমানবন্দরে এই মহানায়ককে দেখে সত্যি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
স্বৈরতন্ত্রী মিশরের এক দরিদ্র পোস্টমাস্টারের ছেলে নাসের পরের বছরই সারা পৃথিবীকে চমকে দিলেন সুয়েজ খাল রাষ্ট্রীয়করণ করে। তখন একদিকে সমস্ত পাশ্চাত্য দেশ ও অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে মিশরের সম্পর্ক বেশ তিক্ত। (কুশ্চেভ হঠাৎ নেহরুকে খবর দিলেন, আগামী দু একদিনের মধ্যে ইংরেজ ও ফরাসীরা মিশর আক্রমণ করবে। খবরটা নাসেরকে জানিয়ে দেবার জন্য ক্রশ্চভ নেহরুকে অনুরোধ করলেন এবং নেহরুও কালবিলম্ব না করে সোভিয়েট গোয়েন্দা দপ্তরের সংগৃহীত এই খবরটি নাসেরকে জানিয়ে দেন। সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে তখন মিশরের সম্পর্ক কী রকম ছিল, তা এই ঘটনার দ্বারাই প্রমাণিত হয়।) তবু এই দুঃসাহসী তরুণ বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি একই সঙ্গে ইজরাইল-ইংরেজ-ফরাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। সারা পৃথিবীর ন্যায় বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ সেদিন নাসেরকে সমর্থন করেন।