ক্রশ্চভের আশেপাশের কূটনীতিবিদ ও অফিসাররা বার বার ঘড়ি দেখতেই আমার খেয়াল হল, আর এক মিনিটও নেই। আমি আর এক মুহূর্ত নষ্ট না করে চিৎকার করে উঠলাম, মিষ্টার চেয়ারম্যান, স্যার! আপনি কি শুধু আমেরিকান সাংবাদিকদেরই প্রশ্নের জবাব দেবেন?
উনি হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, আমি যে এতক্ষণ আমেরিকান সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলাম, তা বুঝতেই পারিনি। এবার আমেরিকান সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে মুচকী হেসে বললেন, আমি আপনাদের যা বলেছি, সব ভুলে যান। তারপর আমাকে বললেন, আপনার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কি ভারত ত্যাগ করতে পারি?
ভারত কি আপনাদের বন্ধুত্বের উপর নির্ভর করতে পারে?
একশ বার। ভবিষ্যত নিশ্চয়ই প্রমাণ করবে, আমরা ভারতের সত্যিকার বন্ধু!
ভারত ত্যাগের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান ক্রশ্চভের সম্মানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বেনেদিকভের পার্টি। সে পার্টিতে প্রধান মন্ত্রী নেহরু, উপরাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণ থেকে শুরু করে রাজধানী দিল্লীর সব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সমাবেশ হয়েছে। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা তো আছেনই। একদল সাংবাদিকের মধ্যে আমিও নিমন্ত্রিত হয়ে সে পার্টিতে গেছি। ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছি এদিক-ওদিক কিন্তু ক্রশ্চভ, নেহরু ও রাধাকৃষ্ণণের চারপাশে অনেকের ভিড় বলে ওদের কাছে যাচ্ছি না। হঠাৎ সোভিয়েত দূতাবাসের একজন উচ্চপদস্থ কূটনীতিবিদ আমাকে এসে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে আসুন।
তারপর উনি আমাকে সোজা ক্রশ্চভের সামনে হাজির করে বললেন, এই যে ওকে ধরে এনেছি।
ক্রশ্চভ আমার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, সেদিন সাংবাদিক সম্মেলনে আপনার প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমি সত্যি খুশি হয়েছি। এই কথাটা জানাবার জন্যই আপনাকে খুজছিলাম।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার বিস্ময় কেটে যাবার পর সেদিনই আমি বুঝেছিলাম, নেহরু-ক্রশ্চভের আলোচনায় সত্যিকার ভারত-সোভিয়েত বন্ধুত্বের বনিয়াদ তৈরী হয়েছে এবং আগামী দিনের ইতিহাস তা প্রমাণ করবে। এত বছর পর আজ নিঃসঙ্কোচে বলা যায়, ভারতবর্ষের বহু সঙ্কটে যে বন্ধু রাষ্ট্র সব সময় পাশে দাঁড়িয়েছে, তার নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। কাশ্মীর, চীন-ভারত যুদ্ধ ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন যেভাবে ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার তুলনা বিরল।
ক্রশ্চভ সম্পর্কে আরো একটি ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না।
আজ খবরের কাগজের পাতায় মানুভাই শা’র নাম ছাপা হয় না। আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে রকম ডিফেন্স পলিসির জন্মজাতা হিসেবে কৃষ্ণমেনন, অয়েল পলিসির জন্মদাতা হিসেবে কেশবদেও মালব্যর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে, সেইরকম রপ্তানী বানিজ্যের মূল বনিয়াদ তৈরীর জন্য মানুভাই শার নাম সবার মনে রাখা উচিত। মানুভাই মন্ত্রী হিসেবে যেমন খ্যাতি অর্জন করেন, পার্লামেন্টিরিয়ান হিসেবেও সবার মন জয় করেন।
যাই হোক মস্কোয় ভারত মেলার আয়োজন হলো মানুভাই শার উদ্যোগে। উনি বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক বনিয়াদ গড়ে তুলতে হলে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য অপরিহার্য এবং ভারত-সোভিয়েত বানিজ্যের খানিকটা সাম্য রক্ষা করতে হলে আমাদের রপ্তানী বাড়াতেই হবে। সোভিয়েত দেশে আমাদের রপ্তানী বৃদ্ধি করার জন্যই সেবার ভারত মেলার আয়োজন হয়। দিল্লী থেকে মস্কো রওনা হবার আগেই মানুভাই জানতেন, ক্রশ্চভের পক্ষে মেলার উদ্বোধন করা সম্ভব হবে না। কারণ ঠিক ঐ সময় মস্কোয় পূর্ব ইউরোপের কমিউনিষ্ট পার্টির প্রধানদের সম্মেলন হবে। তাছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ ব্যক্তিগত দূত হ্যারিম্যানও ঠিক এ সময় সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। তবু মানুভাই প্রধানমন্ত্রী নেহরুর একটা চিঠি নিয়ে গেলেন।
মস্কোয় পৌঁছে মানুভাই ক্রশ্চভকে নেহরুর চিঠি দিতেই উনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, নে, নো, ভেরি বিজি। কান্ত গো। সরি।
ক্রশ্চভ ব্যস্ত বলে সোভিয়েত বিদেশ বানিজ্য মন্ত্রী ভারত মেলার উদ্বোধন করবেন বলে সব ঠিক। আমন্ত্রণপত্র বিলি হয়ে গেছে। বক্তৃতা ছাপান হয়েছে। মেলার উজ্যোগ-আয়োজন সব শেষ।
সেদিন বিকেলেই মেলার উদ্বোধন। মানুভাই সারা সকাল মেলার মাঠে কাটিয়ে দুপুরে হোটেলে এসেছেন। খাওয়া-দাওয়া করে যথারীতি খালি গায় শুয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। হঠাৎ টেলিফোন-হ্যালো!
স্পীক টু চেয়ারম্যান, স্যার।
ক্রশ্চভ স্পীকিং! আই কাম, ইওর একজিবিশন।
সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকে টেলিফোন লাইন কেটে গেল।
হতভম্ব হয়ে মানুভাই নিজের বিছানায় বসে আছেন। ঠিক বুঝতে পারছেন না কি ঘটে গেল। এমন সময় ঘরে ঘন্টা বাজতেই উনি যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। ঘণ্টা শুনে ভাবলেন নিশ্চয়ই আমাদের দূতাবাস থেকে কেউ এসেছেন।
দরজা খুলতেই সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুজন অফিসার মানুভাইকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন ইওর একসলেনসী, চেয়ারম্যান আপনাদের ভারত মেলার উদ্বোধনে আসছেন, সে খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন?
হ্যা এক্ষুনি চেয়ারম্যান টেলিফোন করেছিলেন।
চেয়ারম্যান যখন যাচ্ছেন তখন আপনার বক্তৃতার নিশ্চয়ই কিছু পরিবর্তন হবে। আপনি যদি অনুগ্রহ করে বক্তৃতার প্রথম প্যারাটা লিখে দেন, তাহলে আমরা তা ছাপাবার ব্যবস্থা করতে পারি।