রাজভবন থেকে মার্শাল টিটোর বেরুবার তখনও দেরি আছে। তা হোক। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তর ও পশ্চিমবঙ্গ কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কর্ণধাররা অনেক আগেই রাজভবন পৌঁছে গেছেন এবং কনভয়ের গাড়ি ঠিক মত দাঁড় করিয়ে ড্রাইভার ও নিরাপত্তা কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে মার্শাল টিটো সিঁড়ি ভেঙে নেমে এসে ওদের সামনে হাজির। একা মার্শাল টিটোকে সামনে দেখে গোয়েন্দা দপ্তরের বড় কর্তাদের বিস্ময় আরো বেড়ে গেল। তাছাড়া প্রেসিডেন্টের রওনা হবার কি সময় হয়ে গেল? ওরা সবাই ঘড়ি দেখেন। মার্শাল টিটো হেসে বললেল, না না, আমার রওনা হবার সময় হয়নি। ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। তাই ঘরের মধ্যে বসে না থেকে বেরিয়ে এলাম।
গোয়েন্দা বিভাগের বড় কর্তারা এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
আপনারা কি করছেন?
মার্শাল টিটোর প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন গোয়েন্দা দপ্তরের একজন প্রবীণ অফিসার। তিনি সবিনয়ে বললেন, ইওর একসেলেনসী, আমরা আপনার নিরাপত্তা কর্মী! তাই সবাইকে একটু বুঝিয়ে দিচ্ছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মহানায়ক মৃদু হেসে বললেন, এত ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও কি আপনারা গ্যারান্টি দিতে পারেন আমার কোন বিপদ হবে না?
কি জবাব দেবেন? আমতা আমতা করতে লাগলেন গোয়েন্দা দপ্তরের বড় কর্তারা।
এবার মার্শাল টিটো বললেন, কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই সব বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে না। একজনের নিরাপত্তার জন্য। শত সহস্র নিরাপত্তা কর্মী নিয়োজিত থাকলেও একজন সাধারণ মানুষ ইচ্ছা করলেই অঘটন ঘটাতে পারেন।
গোয়ন্দা বিভাগের একজন অফিসার সাহস করে বললেন, ইওর একসেলেনসী, আমরা তো চেষ্টা করব যাতে অঘটন না ঘটে।
মার্শাল টিটো হেসে বললেন, তা ঠিক কিন্তু অতিরিক্ত কিছু করলে, অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়।
এই নিরাপত্তার ব্যাপারে একটি মজার ঘটনা না বলে পারছি না।
তৈল সমৃদ্ধ একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এসেছেন দিল্লীতে। আছেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। নৈশ ভোজনের বেশ কিছু পরে ঐ দেশের রাষ্ট্রদূত একজন সুন্দরী যুবতাঁকে নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের ঘরে ঢুকলেন কিন্তু কিছুক্ষণ পরে রাষ্ট্রদূত একা বেরিয়ে এলেন এবং ভারপ্রাপ্ত ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসারকে জানালেন, মেয়েটি সারারাত-ঐ ঘরেই থাকবে। ভাল কথা। রাষ্ট্রদূত চলে যাবার একটু পরেই খবর পাওয়া গেল, ঐ রাষ্ট্রপ্রধানের সহযাত্রী দুজন নিরাপত্তা কর্মী স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ঐ ঘরে ঢুকেছে। খবর শুনেই ভারতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা দপ্তরের কর্তারা মাথায় হাত দিয়ে বসলেন! যদি ওরা দুজন রাষ্ট্রপ্রধানের কোন ক্ষতি করে? অথচ ওঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব তো ভারতের। কি করা যায়? ঘরের দরজা খুলতে বলা অসম্ভব। হাজার হোক রাষ্ট্রপ্রধান। তার উপর উনি এখন চিত্তবিনোদনে ব্যস্ত। এ সময় কি মহামান্য অতিথিকে বিরক্ত করা যায়? সারারাত মহা উৎকণ্ঠায় কাটালেন আমাদের নিরাপত্তা-গোয়েন্দা বিভাগের কর্তারা। তারপর ভোরবেলায় ঐ সশস্ত্র প্রহরী দুটি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ভারতীয় অফিসাররা তাদের জিজ্ঞাসা করলেন–আপনারা ঘরে ঢুকেছিলেন কেন?
আমরা পাহারা দিচ্ছিলাম।
পাহারা?
হ্যাঁ। রাষ্ট্রপ্রধানের খাটের তলায় বসে সারারাত পাহারা দিয়েছি।
সেকি?
হা! ঐ মেয়েটি যদি রাষ্ট্রপ্রধানের কোন ক্ষতি করে। তাই ওঁর নির্দেশ অনুযায়ী আমরা রোজ রাত্রেই এই রকম পাহারা দিই।
ওদের কথা শুনে ভারতীয় অফিসাররা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
কিছু কিছু স্বদেশী-বিদেশী ভি-আই-পি নিরাপত্তার নামে অতিরিক্ত কিছু তামাসা সত্যি পছন্দ করেন। অনেকে ঠিক বিপরীত। যেমন মার্শাল টিটো। হো-চি-মিন আর একজন বিশ্ববরেণ্য নেতা যাকে এই বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন দেখেছি। শুধু তাই নয়। দুটি এনগেজমেন্টের মাঝের সময়টুকু তিনি নিজের ঘরে শুয়ে-বসে কাটাতেন না। হাতে সময় পেলেই উনি লনে বসে সাংবাদিক ও অফিসারদের সঙ্গে গল্প করতেন। হো-চি-মিনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল। অন্যান্য ভিভিআই-পিদের মত উনি বার বার পোষাক বদল করতেন না। একটা জামা-প্যান্টেই সারা দিন কাটাতেন! দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে চার্চিল, স্ট্যালিন, মাও সে তুঙ ও ছাগলকে আমি দেখিনি। আর অধিকাংশ রাষ্ট্রনায়ককেই আমি দেখেছি কিন্তু তাদের মধ্যে হো-চি-মিনের চাইতে সহজ সরল অনাড়ম্বর কাউকে দেখিনি। নতুন দেশ ও নতুন জাতির জন্মদাতা ও বিশ্ববরেণ্য নেতা হয়েও উনি ভুলে যাননি, এককালে লণ্ডনের কার্লটন হোটেলে বাসন মাজতেন।
তবে অন্যান্য সব ভি-ভি-আই-পিদের চাইতে ক্রশ্চভের সফর কভার করার সময় সাংবাদিকদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হতো। উনি যে কখন কি করবেন, তা কেউ জানতেন না। তাছাড়া ওঁর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বুদ্ধি এত প্রখর ছিল, তা সত্যি ভাবা যায় না। এর সঙ্গে ছিল ওঁর অসম্ভব স্মৃতিশক্তি ও রসজ্ঞান। ভারত সফরের সময় নানা বিষয়ে নানা জায়গায় ওঁর মন্তব্য কিংবদন্তি হয়ে আছে। তাই সেসব কথার পুনরাবৃত্তি না করে অন্য দুএকটি ঘটনা বলব।
দিল্লীতে ক্রশ্চভের সাংবাদিক সম্মেলন। প্রায় ছসাত শ দেশী বিদেশী সাংবাদিক জড় হয়েছেন। হবে না কেন? ওঁর প্রত্যেকটি কথাই তো তাৎপর্যপূর্ণ। তাছাড়া ওঁর মত উপস্থিত বুদ্ধি সম্পন্ন ও রসিক নেতার সাংবাদিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আনন্দই আলাদা। ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে সঙ্গে নানা দেশের সাংবাদিকরা প্রশ্ন করছেন এবং ক্রশ্চভ তার জবাব দিচ্ছেন। এইভাবে সময় চলে যাচ্ছে। হঠাৎ আমার খেয়াল হয়, আর তো বিশেষ সময় নেই কিন্তু সে সময় উনি একদল আমেরিকান সাংবাদিকদের একটির পর একটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। মার্কিন সাংবাদিকরা যেমন কড়া কড়া প্রশ্ন করছেন, উনি তাদের আরো কড়া জবাব দিচ্ছেন হাসতে হাসতে। শুনতে সবাই মশগুল।