আমরা ওঁর ঘরের মধ্যে পাকৃত মশারী দেখে হাসতেই উনি বললেন, তোমাদের জন্য আমি বিছানা ছেড়ে টেলিগ্রাফ অফিস যাই। তোমরা যখন আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছ, তখন আমিই বা কেন তোমাদের ঘুমুতে দেব?
আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠি।
সেদিন বাকি রাতটুকু নেহরু আর আমরা কজনে গল্প করেই কাটিয়ে দিই।
পরদিন ভোরবেলায় নেহরু হাসতে হাসতে আমাদের বললেন, পুলিশে এফ-আই-আর করনি তো? এফ-আই-আর করলে ওরা আমাকে চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করবে।
ঐ একরাত্রির আনন্দের জন্য সমস্ত নির্বাচনী সফরের ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিল।
ভিআই-পি কথাটি আমাদের দেশে বড়ই অপব্যবহার করা হয় এবং দিন দিন এই অপব্যবহার বাড়ছে। প্রথম যখন রিপোর্টার হলাম, তখন বিদেশী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ছাড়া আমাদের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ভি-আই-পি ছিলেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীরাও ভি আই-পি ছিলেন ঠিকই কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সরকারী অনুষ্ঠান ও নিজ নিজ রাজ্যের মধ্যে সীমিত ছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কোন রাজ্যে সফরে গেলে তাঁরা রাজভবনে থাকতে পারতেন এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো ঠিকই কিন্তু আজকের মত তারা পুলিশের গাড়ির শোভাযাত্রার শোভা বর্ধন করতেন না। দিল্লীতেও তাদের সঙ্গে সব সময় একজন সাধারণ পোষাকের নিরাপত্তা কর্মী থাকলেও বাড়ির দরজায় সঙ্গীনধারী মোতায়েন ছিল না। সঙ্গীনধারী মোতায়েন থাকত শুধু রাষ্ট্রপতি ভবনে ও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর তিনমূর্তি ভবনে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বাংলোয় প্রথম সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করা হয় চীন-ভারত যুদ্ধের সময়। যুদ্ধ শেষ হবার পর সশস্ত্র প্রহরীরা ব্যারাকে ফিরে যায়।
ভি-আই-পি কনভয়ের অগ্রগামী পুলিশের গাড়িতে সাইরেন ব্যবহার প্রথম চালু হয় বম্বেতে এবং তার জন্য মহারাষ্ট্র সরকারকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নিতে হয়। ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরের চাইতে বোম্বেতেই মোটর গাড়ির সংখ্যা সর্বাধিক ও গতিও অত্যন্ত বেশী। তাই দ্রুতগামী যানবাহনকে অনেক দূর থেকে সতর্ক করার জন্যই এই সাইরেন ব্যবহার চালু হয়। শুধু তাই নয়। বিশেষ বিশেষ ভি-আই-পির বিশেষ বিশেষ স্থানের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে যোগদানের সময়ই এই সাইরেন ব্যবহার চালু ছিল এবং এখনও এই ব্যবস্থা সত্যিকার ভি-আই-পিদের জন্যই নিদিষ্ট আছে। কিছু কিছু রাজ্যে পশুপালন ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীর গ্রাম গঞ্জ সফরের সময়েও এই সাইরেন ব্যবহার হচ্ছে।
ভি-আই-পি গাড়ির সামনে লাল আলো? পৃথিবীর বহু দেশেই অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ির সামনে লাল-নীল ফ্লিকারিং আলো থাকে কিন্তু ভি-আই-পি গাড়ির সামনে নৈব নৈব চ। এখনও দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর গাড়িতে লাল আলো নেই। যাই হোক এই সব ব্যবস্থাই নাকি নিরাপত্তার জন্য। কমিউনিষ্ট ও একনায়কতন্ত্রের দেশগুলিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্যি অভাবনীয় কঠোর। তবে কমিউনিষ্ট দেশে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমনই যে তা সাধারণের দৃষ্টি গোচরে পড়ে না। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত নগ্ন ও প্রকট শুধু একনায়কতন্ত্রের দেশগুলিতে। এই ধরণের অমার্জিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে এই সব ডিক্টেটররা দেশের মানুষকে ভয় করেন। সব গণতান্ত্রিক দেশেও ভি-আই-পিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তা কঠোরতম কিন্তু ভারতবর্ষের মত এমন অমার্জিত নয়। লরী ও জীপ ভর্তি সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে মন্ত্রীদের সফর করা কোন সভ্য দেশে দেখা যাবে না।
সুইজারল্যাণ্ডের রাষ্ট্রপ্রধান সাধারণ মানুষের সঙ্গে ট্রামে চড়ে অফিস যান। সুইডেন প্রভৃতি দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সশস্ত্র বা নিরস্ত্র প্রহরী তো দূরের কথা, কোন ব্যক্তিগত কর্মচারীও থাকেন না। কোন দর্শনার্থী গেলে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তাকে অভ্যর্থনা করবেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও অফিস দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীটে কোন অর্ডালী-চাপরাশী-বেয়ারা বা কলিং বেলের ব্যবস্থা নেই। কোন কর্মচারীকে দরকার হলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নিজে তার ঘরে গিয়ে ডেকে আনেন–জন, উড ইউ প্লীজ ড্রপ ইন? আর গণতান্ত্রিক প্রগতিবাদী পশ্চিমবঙ্গের সাব-রেজিষ্ট্রাররাও ঘণ্টা বাজিয়ে একজন বেয়ারাকে তলব করেন ও জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের বাংলোয় টেলিফোন ধরে একজন সিপাই! মন্ত্রী-সেক্রেটারিরা তো চন্দ্র-সূর্যের মতই বহুদূরের বাসিন্দা। গরীব মানুষের টাকায় এই বিলাসিতা সত্যি বিস্ময়কর। যাই হোক এ দেশে খুদে ভি-আই-পিদেরও ঢং দেখে হাসি পায়।
জীবনে কত অসংখ্য ভিআইপি দেখলাম, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও নানা রকম কায়দা-কানুন করে সাধারণ মানুষ থেকে দূরে থাকাই, আমাদের বাচাল বক্তৃতা-শ্লোগান সর্বস্ব ভিআই-পিদের স্বপ্ন ও সাধনা। মনে পড়ে মার্শাল টিটোর কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চল্লিশ ডিভিশন নাৎসী সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে বিশ্বের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন মার্শাল টিটো। যুদ্ধবিগ্রহ শত্রু-মিত্র অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তার মত অভিজ্ঞ রাষ্ট্রপ্রধান বিরল। ইতিহাসের সেই অমর নায়ক এসেছেন ভারত সফরে এবং ঘুরতে ঘুরতে কলকাতা।