শ্ৰীমতী পণ্ডিত সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এ তো পরম সৌভাগ্যের কথা।
এবার রাণী লর্ড মার্লবোরা ও ভারতস্থ ব্রিটিশ হাই কমিশনারকে বললেন, আপনারা এখুনি প্রেসিডেন্ট আয়ুবকে জানিয়ে দিন, আমি একঘণ্টা দেরিতে পাকিস্তান পৌঁছব। দ্য বয়েজ মাস্ট হাভ সাম শ্লিপ। একটু না ঘুমুলে ওরা সারাদিন কাজ করবে কি করে?
রাণীর এই সিদ্ধান্তের জন্য সাংবাদিকরা সে রাত্রে সত্যি একটু ঘুমিয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে ঠিক বিপরীত একটি অভিজ্ঞতার কথা।
প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে নির্বাচনী সফরে গেছি মধ্যপ্রদেশ। সারা দিনে উনি দশ-বারোটা নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিচ্ছেন এবং সেইসঙ্গে শত শত মাইল ঘুরতে হচ্ছে। কখনও কখনও হঠাৎ পথের ধারের জনতার অনুরোধেও প্রধানমন্ত্রী দুপাঁচ মিনিট বক্তৃতা দেন। কখনও আবার হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে আশেপাশের গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেন। সুযোগ পেলে ওদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একটু-আধটু রসিকও করেন।
সাধারণ মানুষ নেহরুকে চুম্বকের মত টানত এবং তাই আমরা যে কজন সাংবাদিক ওঁর সঙ্গে সফর করছিলাম, তাদের প্রতি মুহূর্ত অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হতো। হাজার হোক নেহরু। ওঁর সবকিছুই তো নিউজ। নেহরুর এই ধরণের সফর কভার করার একটা সমস্যা ছিল। উনি এক এক সময় ভাবাবেগে এমন এক একটি মন্তব্য করতেন, যা ঔরই আর একটি মন্তব্যের ঠিক বিপরীত। একই দিনে অনেক সভাসমিতিতে বক্তৃতা দিলে এই ধরণের সমস্যা দেখা দিত। নেহরুর প্রতিটি মন্তব্যে দেশের মধ্যে ও বিদেশে নানা রকম প্রতিক্রিয়া হতো বলে এই ধরণের পিরীতধর্মী মন্তব্য রিপোর্ট করা সম্পর্কে আমাদের যেমন সমস্যা দেখা দিত, সেই রকম সতর্ক থাকতে হতো। তবে অধিকাংশ সময়ই নেহরু নিজে এই সমস্যার সমাধান করে দিতেন।
ঐ মধ্যপ্রদেশ সফরের সময় আমরা ( নেহরুর সফর সঙ্গী সাংবাদিকরা) প্রত্যেকটি সভার আলাদা আলাদা রিপোর্ট পাঠাতাম না। সারা দিনের সব সভার মূল ও প্রধান প্রধান বক্তব্যগুলিকে নিয়ে একটা বড় রিপোর্ট লিখতাম এবং সে খবর পাঠাবার আগে নেহরু নিজে একবার দেখে দিতেন। এইভাবেই দুটো দিন কাটল।
তৃতীয় দিনেও ঐ একই কর্মসূচী। সকাল আটটা-সাড়ে আটটায় ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা। তারপর পাঁচ-সাতটা ছোট-বড় মিটিং-এর পর চার-পাঁচশ মাইল দূরে কোন শহরে বা গ্রামের সরকারী আস্তানায় মধ্যাহ্ন ভোজন। আধঘণ্টার বিশ্রামের পরই আবার যাত্রারম্ভ। রাত সাড়ে আটটা-নটায় রাত্রি যাপনের জন্য যেখানে পৌঁছলাম তা সত্যিই হট্ট মন্দির। অত্যন্ত ছোট দুখানি পাকা ঘর। এখানে প্রধানমন্ত্রীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে এবং তার সহযাত্রী সরকারী অফিসার ও সাংবাদিকদের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা হয়েছে। যাইহোক আমরা পৌঁছবার পরই মিলেমিশে রিপোর্ট তৈরী করলাম এবং তারপর নেহরুকে দেখাবার জন্য ওঁর ঘরে গিয়ে দেখি, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর উনি ঘুমুচ্ছেন বলে আমরা ওঁর ঘুম ভাঙান অনুচিত মনে করে আবার সবাই মিলে রিপোর্টটিকে ভালভাবে দেখলাম। তারপর আমরা দুতিনজনে একটা জীপ নিয়ে মাইলখানেক দূরের টেলিগ্রাফ অফিসে গেলাম। টেলিগ্রাফ অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী আমাদের প্রেস টেলিগ্রামের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন এবং আমরা তার হাতে মেসেজ দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার কাজ শুরু করলেন। কয়েক মিনিট পরেই আমরা আরেকটা জীপগাড়ীর আওয়াজ পেলাম কিন্তু ভাবলাম বোধ হয় কোন সরকারী অফিসার টেলিগ্রাম পাঠাতে এসেছেন এবং আমরা কেউই সেদিকে খেয়াল করিনি। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে টেলিগ্রাফ অফিসের ভিতরে তুকে টেলিগ্রাফিস্টকে বকুনি দিতেই আমরা সবাই ভুত দেখার মত চমকে উঠি। উনি টেলিগ্রাফিস্টকে বললেন, এরা সবাই আমার সম্পর্কে আজেবাজে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে, তা জানেন?
নেহরুর কথায় ভদ্রলোকের হৃদপিণ্ডের স্পন্দনও বোধ হয় থেমে যায়।
এবার প্রধানমন্ত্রী আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তোমরা ভালভাবে দেখেশুনে রিপোর্ট পাঠাচ্ছ তো?
হা।
ব্যস! তাহলে ঠিক আছে। হাসতে হাসতে নেহরু টেলিগ্রাফিস্টকে বললেন, তাড়াতাড়ি খবর পাঠান। তা না হলে কাল সকালেই কাগজে বেরুবে কি করে?
টেলিগ্রাফিস্ট ভদ্রলোক অভাবনীয়ভাবে ভারতভাগ্যবিধাতার সান্নিধ্য লাভ করে আনন্দে খুশিতে নিউজ পাঠাতে শুরু করলেন এবং আমরা সবাই ক্যাম্পে ফিরে এলাম। নেহরু তার নিজের ঘরে গেলেন। আমরাও যে যার তাঁবুতে এসে জামাকাপড় বদলে ও মশারী ঠিকঠাক করেই শুয়ে পড়লাম। আমরাও অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলাম। তাই শোবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত তখন গভীর।
অঘোরে ঘুমুচ্ছি কিন্তু মশার কামড়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ঘুম ভেঙে যেতেই অবাক-মশারী উধাও। অন্য সাংবাদিক বন্ধুদেরও মশারী উধাও। আশ্চর্য কাণ্ড! চারদিকে সশস্ত্র পুলিশের পাহারা এবং এই অবস্থায় আমাদের মশারী চুরি করল কে? তাঁবুর বাইরে পাহারারত সশস্ত্র পুলিশকে প্রশ্ন করে কিছুই জানা গেল না। অনেকক্ষণ অনেককে জিজ্ঞাসা করার পর একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার চাপা হাসি হেসে নেহরুর ঘরের দিকে ইসারা করলেন।
নেহরুর ঘরে গিয়ে দেখি, উনি বই পড়ছেন এবং আমাদের দেখেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, কি? ঘুম হলো না?