সলজ্জ হাসি হেসে ছেলেটি বলল, না।
প্রিন্স এবার গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি কি বিবাহিত?
না।
এবার বিবাহের পাত্রীকে প্রিন্স জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দেশে তো অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে হয়। তা তোমারও কি বিয়ে হয়ে গেছে?
মেয়েটি একটু হেসে বলল, না।
অনুষ্ঠানের গণ্যমান্য দর্শকদের সামনেই প্রিন্স ওদের দুজনের লেখাপড়া ও পরিবারের খোঁজখবর নিলেন। জানা গেল, দুটি ছেলেমেয়েই অত্যন্ত সম্রান্ত পরিবারের সন্তান ও দুজনেই উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে। এবার প্রিন্স ওদের দুজনকে একটু কাছে নিয়ে বললেন, তোমাদের দুজনকেই দেখতে অত্যন্ত সুন্দর। এবার তোমরা বল, দুজনে দুজনকে পছন্দ হয় কিনা।
প্রিন্সের প্রশ্ন শুনে বিশিষ্ট অতিথিরা হেসে ওঠেন আর লজ্জায় ছেলেমেয়েটি মুখ নীচু করে হাসে।
ওদের পাশে দাঁড়িয়ে রাণী, শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, লর্ড মার্লবোরা, গুজরাতের গভর্ণর ও মুখ্যমন্ত্রী হাসেন।
প্রিন্স চুপ করে থাকেন না। বলেন, আমি জানি, এ দেশের ছেলেমেয়েরা অধিকাংশ সময়ই নিজেদের পছন্দমত বিয়ে করতে পারে না। তাই বলছি, তোমরা খোলাখুলি বল বিয়ে করবে কিনা। প্রিন্স একটু হেসে বললেন, তোমরা বিয়ে করতে চাইলেও হয়তো বাবা মার আপত্তির জন্য বিয়ে করতে পারবে না। তাইতো তোমরা যদি
তোমাদের মনের ইচ্ছা আমাকে জানাও, তাহলে এখনই তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা আমি পাকাপাকি করে দিতে পারি।
প্রিন্সের কথায় আমরা সবাই হো হো করে হাসি।
মঞ্চ থেকে নেমে আসার আগে প্রিন্স বললেন, আমার মনে হয়, তোমাদের বিয়েতে তোমাদের অভিভাবকরা আপত্তি করবেন না। যাই হোক আমি তোমাদের দুজনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেলাম।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি একটু দীর্ঘই ছিল। তারপর এইসব ঘটনার জন্য অনেক রাত হয়ে যায়। অনুষ্ঠান শেষে আমরা রাণী ও প্রিন্সের পিছন পিছন হাঁটছি। আমার বিশেষ বন্ধু ওকুইন্স প্রেস পার্টির অন্যতম সদস্য গার্ডিয়ান পত্রিকার মাইকেল ওয়াল হঠাৎ ঘড়ি দেখেই আমাকে বলল, নিমাই, আর দুঘণ্টা পরেই তো লগেজ হাওভার করতে হবে। আজ আর ঘুম হবে না।
এই প্রসঙ্গে দুএকটি কথা বলা প্রয়োজন। ভিভিআই-পির সঙ্গে সফর করা নিশ্চয়ই বিশেষ সৌভাগ্যের ব্যাপার। অনেক বিচিত্র ও অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় হয় এইসব সফরে কিন্তু সেই সঙ্গে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়।
রানী এলিজাবেথের ভারত সফরের সময় প্রেস পার্টির জন্য এয়ার ইণ্ডিয়ার একটা আলাদা বিমান ছিল। রাণীর রয়্যাল ব্রিটানিকা বিমান ছাড়ার আধঘণ্টা আগেই কুইন্স প্রেস পার্টির বিমান রওনা হত এবং নতুন শহরে-নগরে রাণীর স্বাগত অভ্যর্থনা আমরা কভার করতাম। রাণীকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য বিমানবন্দরে যে গণ্যমান্যবরেণ্যরা উপস্থিত থাকতেন, তারাও আমাদের সৌভাগ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হতেন। ভি-ভি আই-পির সহযাত্রী বলে তখন আমরাও ভি-আই-পি। আমাদের থাকা-খাওয়া গাড়ি-ঘোড়া ঘোরা-ফেরার তদারক করতেন অতি উচ্চপদস্থ অফিসারের দল। শুধু কি তাই? আমাদের মালপত্র দেখাশুনার জন্য ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার ও একদল সাধারণ অফিসার নিযুক্ত থাকতেন। তবে আমাদের বিমান রওনা হবার চার ঘণ্টা আগে আমাদের মালপত্র, ওদের হাতে দিয়ে দিতে হতো। তারপর সব মালপত্র নিয়ে একখানি বিমান রাণীর বিমান ছাড়ার তিন ঘণ্টা আগেই পরবর্তী গন্তব্যস্থলে রওনা হতো এবং সেখানে আমাদের পৌঁছবার বহু আগেই আমাদের মালপত্র যার যার নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে যেত। অর্থাৎ রাণী কোন শহর থেকে সকাল আটটার সময় রওনা হলে আমাদের মালপত্র জমা দিতে হতে রাত সাড়ে তিনটেয় এবং সেজন্য এর ঘণ্টাখানেক আগেই আমাদের বাথরুমে ঢুকতে হতো ও সাড়ে তিনটের মধ্যেই সাজগোজ সারতে হত। রাত একটা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ককটেল পার্টিতে থাকার পর রাত সাড়ে তিনটের মধ্যে সারাদিনের মত তৈরী হয়ে নেওয়া নিশ্চয়ই খুব সুখকর নয়। তাই আমেদাবাদ রাজভবন থেকে বেরুবার সময় ওয়াল আমাকে বলল, আজ আর ঘুম হবে না।
পরের দিন সকালেই রাণীর করাচী যাত্রা। তাছাড়া রাণীর সফরসূচীর বিন্দুমাত্র অদলবদল তো হবে না। তাই আমি মাইকেল ওয়াকে বললাম, এখন ঘুমুলে নিশ্চয়ই ঠিক সময় তৈরী হওয়া যাবে, না। গল্প করেই আমাদের সময় কাটাতে হবে।
আমাদের ঠিক সামনেই হাঁটছিলেন রাণী, প্রিন্স ফিলিপ, লর্ড মার্শবোরা ও ব্রিটেনে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার শ্রীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত। রাণী মাইকেল ও আমার কথা শুনতে পেয়েই লর্ড মার্ক্সবোরাকে বললেন, লর্ড, প্লীজ চেক আপ হোয়াট দ্য প্রেস বয়েজ বিহাইণ্ড মী আর সেইং।
সঙ্গে সঙ্গে লর্ড মার্লবোরা একটু পিছিয়ে এসেই মাইকেলকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি বলাবলি করছিলে তা কুইন জানতে চাইছেন।
কুইনের নাম শুনেই রাজভক্ত মাইকেলের চক্ষু ছানাবড়া। লজ্জায় সে প্রায় মারা যায় আর কি। ওর অসহায় অবস্থা দেখে আমিই লর্ড মার্লবোরাকে বললাম, ঘণ্টা আড়াই পরেই প্রেস পার্টির লগেজ হাণ্ডওভার করতে হবে। তাই বলছিলাম, আজ আর ঘুম হবে না।
লর্ড মার্লবোরা সঙ্গে সঙ্গে রাণীকে সে কথা জানালেন এবং রাণী সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী পণ্ডিতকে বললেন, আমরা আপনার দেশে কাল সকালে যদি একঘণ্টা বেশি থাকি তাহলে কি আপনাদের খুব অসুবিধে হবে?