উনি আমার কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। চিৎকার করে বললেন, আমি রেলওয়ে অফিসারদের বলেছি, আপনাকে অন্য কোন বগীতে একটা বার্থ দিতে। এই ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্টে নন্দাজী যাবেন।
আমি জানি, এই বগী ছাড়লে আমি সোজা দিল্লী যেতে পারব না এবং কদিন যে আমাকে নাগপুরে পড়ে থাকতে হবে, তার ঠিক নেই। তাই ভদ্রলোককে স্পষ্ট বললাম, হৈ-হুল্লোড় করে লাভ নেই। আমি এই বগীর এই কামরার এই বার্থে শুয়ে-বসেই দিল্লী যাব।
ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, দ্যাট কান্ট বী। এই বগীতে আর কোন ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্ট খালি নেই; সুতরাং এইটাতেই নন্দাজী যাবেন।
আমি হেসে বললাম, আমি পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর বা কোন বেনিয়া না যে নন্দাজীর নাম শুনেই ভয়ে এই কামরা ছেড়ে পালিয়ে যাব। এখানে তিনটে বার্থ খালি আছে। ইচ্ছা করলে শুধু নন্দাজী কেন, আপনিও এই কামরায় যেতে পারেন।
আমার কথায় ভদ্রলোক আহত ব্যাঘ্রের মত হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন। বললেন, সেন্ট্রাল মিনিস্টাররা সব সময় ফোর-বার্থ কম্পার্টমেন্টে ট্রাভেল করেন।
আমি বললাম, নন্দাজী তো সরকারী কাজে এখানে আসেননি; এসেছেন কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে। তাই এই কামরায় আমি থাকলে তার মত সোস্যালিস্টের জাত যাবে না।
এই চিৎকার চেঁচামেচি শুনে পাশের কামরার দু-চারজন সহযাত্রী ছাড়াও অনেক রেল কর্মমারী এগিয়ে এলেন। এই কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য কলকাতা থেকে সাউথ ইস্টার্ণ রেলের অনেক বাঙালী কর্মচারী রায়পুর গিয়েছিলেন। তারা আমার অনমনীয় মনোভাব দেখে মহা খুশি। কয়েকজন রেলওয়ে অফিসারও আমাকে অনুরোধ-উপরোধ করলেন কিন্তু তাদের আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, নগদ টাকায় টিকিট কেটেছি। রিজার্ভেশন চার্ট দেখে বসেছি। সুতরাং কোন কারণেই এ কামরা ছাড়ছি না। তাছাড়া এ বগী ছাড়লে আমি সোজা দিল্লী যেতে পারব না।
শেষ পর্যন্ত নন্দাজী দুই বার্থের একটা কূপেতে গেলেন এবং আমার কামরায় নন্দাজীর তিনজন ব্যক্তিগত কর্মচারী এলেন। মজার কথা, যার সঙ্গে আমার এত তর্ক-বিতর্ক হল, তিনি অবাঙালী হলেও বাঙালী মেয়েকে বিয়ে করেছেন এবং দিল্লী যাবার পথেই তার সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল।
***
এই তর্ক-বিতর্কের ফলে আরো একটা সুফল হল। আমাদের বগীতেই এস. কে. পাতিল, কে, ডি, মালব্য ও আরো কয়েকজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছাড়াও মধ্যপ্রদেশের দু-তিনজন মন্ত্রীও সফর করছিলেন। ঐ তর্ক-বিতর্কের ফলে আমি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম এবং দীর্ঘ যাত্রাপথে আমিও তাদের বন্ধু হয়ে গেলাম। মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে এক চাঞ্চল্যকর কাহিনী জানতে পারলাম।
কিছুদিন আগেই ভূপালের নবাব দেহত্যাগ করেছেন। নবাবের দুই বেগম। বড় বেগমের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে পতৌদীয় বেগম। ছোট মেয়ে পাকিস্তান চলে গেছেন। ভূপালের নবাবের বড় বেগম খুবই ধর্মপ্রাণা। বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপারে তিনি উদাসীন। সারাদিনই মালা জপ করেন। ছোট বেগম ঠিক এর বিপরীত। ছোট বেগমের কোন সন্তান নেই কিন্তু বড় বেগমের ছোট মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিশেষ অন্তরঙ্গ।
ভূপালের নবাবের মৃত্যুর পর পরই ভূপাল নবাবের গদী ও সেই সঙ্গে রাজ ভাতার দাবীদার হলেন ওর দুই মেয়ে। পতৌদীর বেগম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থকে বললেন, আমি শুধু নবাবের বড় মেয়ে নই, ভারতীয় নাগরিকও। সুতরাং ভূপালের গদী ও রাজন্য ভাতা যেন কেন্দ্রীয় সরকার আমাকেই দেন।
করাচী থেকে উড়ে এলেন নবাবের ছোট কন্যা। পন্থজীর ব্যস্ততার জন্য ওকে কদিন অপেক্ষা করেই তার সঙ্গে দেখা করতে হল।–আমি নবাবের ছোট মেয়ে ঠিকই কিন্তু নবাব আমাকেই বেশী ভালবাসতেন এবং তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন আমিই ভূপালের গদী পাই।
পন্থজী অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে বললেন, ভূপালের গদী বা রাজন্য ভাতা তো আমরা কেউ নেব না, আপনাদেরই কোন বোনকে দেওয়া হবে। আপনার দাবী যে যুক্তিযুক্ত তার যদি প্রমাণ থাকে, তা আমাদের দেবেন। আমরা দুজনের দাবীই পরীক্ষা করে যাকে উপযুক্ত মনে করব তাকেই রাজন্য ভাতা ও ভূপালের গদী দেওয়া হবে।
স্বৰ্গত নবাবের ছোট মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে পন্থজীর হাতে কিছু কাগজ পত্র দিয়ে বললেন, এইসব চিঠি ও কাগজপত্র দেখলেই বুঝবেন, আমার দিদির চাইতে আমার দাবী অনেক বেশী যুক্তিযুক্ত।
পন্থজী অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে বললেন, আপনার আপত্তি না থাকলে কাগজপত্র রেখে যান। আমরা পরীক্ষা করে দেখব।
এবার নবাব-নন্দিনী বললেন, আমি করাচী থেকে সোজা দিল্লী এসেছি। আপনি ব্যস্ত ছিলেন বলে এখানেই কদিন কেটে গেল। ভাবছিলাম, কদিনের জন্য ভূপাল যেতাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ, যাবেন বৈকি।
আপনার সঙ্গে আবার কবে দেখা করব?
ভূপাল থেকে একটা টেলিফোন করেই চলে আসবেন। ব্যস্ত না থাকলে যখনই আসবেন, তখনই দেখা করব।
নবাব-নন্দিনী ভূপাল চলে গেলেন।
ভূপালের বড় বেগম এ সব ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও ছোট বেগমও ছুটে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পন্থজীর কাছে। তিনি বড় বেগমের ছোট মেয়ের দাবীকে সমর্থন করে বলেন, নবাবের শেষ জীবনে আমিই তার ঘনিষ্ঠতম ছিলাম এবং নানা বিষয়ে তার মনের কথা আমাকে বলতেন। আমি জোর করে বলতে পারি, নবাব তাঁর ছোট মেয়েকেই বেশী ভালবাসতেন এবং তিনি চেয়েছিলেন, তার মৃত্যুর পর ছোট মেয়েই ভূপালের গদীতে বসুক।