যাই হোক পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে গিয়েই দেখি, ঐ দুজন বাঙালী নায়িকা একটা টেবিলে বসে আছেন। চেহারা দেখেই বুঝলাম, রাত্রে ওদের উপর দিয়ে সাইক্লোন বয়ে গেছে। ওদের কাছে গিয়ে মাথা নীচু করে হাসি মুখে বললাম, গুড মর্ণিং।
ওরা দুজনেই হেসে বললেন, মর্ণিং!
এবার সোজাসুজি বাংলায় বললাম, কাল রাত্রের পার্টিটা খুব জমেছিল, তাই না?
ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি কুইন্স পার্টিতে আমার মত একটি বঙ্গজ সন্তান থাকতে পারে। তাই আমার কথায় ওরা দুজনে চমকে উঠে কোন মতে বললেন, হ্যাঁ।
আবার আমি বললাম, কাল রাত্রে আপনাদের দুজনকে দেখে খুব ভাল লাগল। কুইনের সঙ্গে এত ঘুরছি কিন্তু আপনাদের মত এমন প্রাণবন্ত ও স্ফুর্তিবাজ মেয়ে দেখিনি। রিয়েলি আই ওয়াজ ভেরি ভেরি হ্যাপি টু সী ইউ ইন সাচ এ মুড লাস্ট নাইট।
আমি আর এক মুহূর্ত দেরি না করে অন্য টেবিলের দিকে এগুলাম। ওরা নির্বাক হয়ে বসে রইলেন।
এই সফরের সময় আরো অনেক মজার ঘটনা ঘটেছিল।
কুইন্স প্রেস পার্টির আমরা সবাই এয়ার ইণ্ডিয়ার একটা সুপার কনস্টেলেশনে ঘুরতাম। ইণ্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একজন আঞ্চলিক অধিকর্তা মিঃ শ্রীবাস্তব ছিলেন কুইন্স পার্টির এয়ার মুভমেন্ট অফিসার। উনিও আমাদের প্লেনেই সফর করতেন। রাণী ঘুরতেন তার রয়্যাল ব্রিটানিকাতে। আমাদের প্রেস পাটির প্লেনে একজন মাত্র এয়ার হোস্টেস ছিলেন। আর কয়েকজন স্টুয়ার্ট। এয়ার হোস্টেস মেয়েটি অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ছিল। রঙ একটু চাপা হলেও মেয়েটি অত্যন্ত সুন্দরী ছিল এবং তাকে নিয়ে কুইন্স প্রেস পার্টিতে বেশ সরস আলোচনা হতো।
মিঃ শ্রীবাস্তব বেশ বয়স্ক ছিলেন এবং দেখতেও বিশেষ ভাল ছিলেন না। কালো মোটা ও মুখে বসন্তের দাগওয়ালা এই প্রবীণ অফিসারটি সুযোগ পেলেই এয়ার হোস্টেস মেয়েটির গায়ে হাত দিয়ে কথাবার্তা বলা বা আইল দিয়ে যাতায়াতের সময় একটু ধাক্কা লাগাতে বড় ভালবাসতেন। আমি বেশ বুঝতে পারতাম মেয়েটি ওর এই ব্যবহার একটুও পছন্দ করেন না কিন্তু মুখে কিছু বলার সাহস হয় না। আর লক্ষ্য করতাম একজন স্টুয়ার্টের কাছে ও যেন একটু বেশী সহজ ও ঘনিষ্ঠ। অনুমান করলাম, ওদের মধ্যে ভালবাসা আছে।
আমি একদিন মিঃ শ্রীবাস্তবকে হাসতে হাসতে বললাম, আমার মত ইয়াং স্যাণ্ডসাম লোক থাকতে আপনি কেন মেয়েটির সঙ্গে খাতির করার চেষ্টা করেন?
এই ঘটনার পর মিঃ শ্রীবাস্তব সত্যি একটু সংযত হলেন এবং মেয়েটি ও স্টুয়ার্ট আমার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
কলকাতা থেকে আমাদের প্লেন মাদ্রাজ রওনা হওয়ার পর পরই প্রেস লিয়াজো অফিসার আমাদের হাতে মাদ্রাজের প্রোগ্রাম, নানা অনুষ্ঠানের নেমন্তন্ন কার্ড, থাকা ও গাড়ির বিধিব্যবস্থার কাগজপত্র হাতে দিলেন। মাদ্রাজে রাণীর সম্মানে রাজভবনে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাতে বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নৃত্য শিল্পী পদ্মিনীর নাচ ছিল। আমাদের প্রেস প্লেনের কমাণ্ডার অব দ্য এয়ারক্রাফটকে এই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ-লিপি দেওয়া হলেও বিমানের আর কোন কর্মীকে আমন্ত্রণ করা হয় না। প্লেনের মধ্যে ঘোরাঘুরি করার সময় এয়ার হোস্টেস আর ঐ স্টুয়ার্টের কথাবার্তা শুনে বুঝলাম, ওরা পদ্মিনীর নাচ দেখতে খুবই ইচ্ছুক কিন্তু দেখা হবে না।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ঐ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমার কার্ডটি এনে স্টুয়ার্টকে দিয়ে বললাম, আপনি এই কার্ড নিয়ে চলে যাবেন। আর মেয়েটিকে বললাম, আমাদের রওনা হবার আগে আপনি একটা সুন্দর শাড়ি পরে হোটেলে আমার কাছে আসবেন এবং আমি আপনাকে নিয়ে যাব।
প্রেস পার্টির কোন সদস্যরই কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য কার্ড লাগত না। কারণ আমরা সব সময় ভিআইপি কনভয়ের গাড়িতেই যেতাম। তাই সেদিন সন্ধ্যায় এয়ার হোস্টেস মেয়েটিকে নিয়ে আমি নির্বিবাদে রাজভবনে পৌঁছলাম। অনুষ্ঠান হলে প্রবেশের সময় আমি আলতো করে মেয়েটির হাত ধরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশদ্বারের অফিসাররা ভাবলেন, আমরা স্বামী-স্ত্রী।
হলে প্রবেশ করেই আমি মেয়েটিকে বললাম, যান, আপনার বন্ধুর কাছে গিয়ে বসুন।
অশোককুমারের দৌলতে পদ্মিনীর সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। তাই অনুষ্ঠান শেষে আমি ওদের সঙ্গে পদ্মিনীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললাম, জানেন, আমি আর এই বিমান সেবিকাটি কয়েক মিনিটের জন্য স্বামী-স্ত্রীর অভিনয় করেছি।
আমার কথায় সবাই হেসে উঠলেন।
এমন সময় হঠাৎ আমাদের পুরনো বন্ধু ও ফিল্ম ডিভিশনের ক্যামেরাম্যান রাও মঞ্চে এসে আমাকে বলল, পদ্মিনী যদি আবার নাচেন তাহলে আমি ভাল করে তুলে নিতাম।
রাও এর অনুবোধ পদ্মিনীকে জানাতেই উনি আবার পর্দার আড়ালে বেশ কিছুক্ষণ নাচলেন। এয়ার হোস্টেস ও স্টুয়ার্ট মহা খুশি। পদ্মিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসতেই রাও হাসতে হাসতে বলল, জানিস, আমার ক্যামেরায় ফিল্মই ছিল না।
রাও আবার হাসতে হাসতে বলল, অত কাছ থেকে অমন একজন অভিনেত্রী ও ডালারের নাচ দেখার লোভ কী ছাড়া যায়?
রাণী এলিজাবেথের সফরে আবো কিছু মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। মনে পড়ছে আমেদাবাদের কথা।
আনুষ্ঠানিক নৈশ ভোজের পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে রাজভবনের বিস্তীর্ণ লনে। সবরমতীর তীরে আজকের এই রাজভবনেই এককালে প্রথম ভারতীয় আই-সি-এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করতেন এবং সে সময় রবীন্দ্রনাথও এখানে এসেছেন। যাই হোক অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানের পর গুজরাটীদের বিবাহ উৎসবও রাণী ও প্রিন্স ফিলিপকে দেখান হয়। অনুষ্ঠান শেষে রাণী ও প্রিন্স ফিলিপ মঞ্চে উঠে সমস্ত শিল্পীদের সঙ্গে মিলিত হন ও তাদের অভিনন্দন জানান। হঠাৎ ফিলিপ নকল বিবাহ অনুষ্ঠানের বরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি সত্যিকার স্বামী-স্ত্রী?