আধঘণ্টা পরেই আবার টেলিগ্রাম। কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী বি. ভি. কেশকার লিখেছেন, আপনাদের অসুবিধার খবর জেনে দুঃখিত। যাই হোক অনুগ্রহ করে রাণীর সফরের খবর পরিবেশন করা বন্ধ করবেন না। প্রাইম মিনিস্টার যথোচিত ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
এর কিছুক্ষণ পরেই আবার দরজায় করাঘাত। রাত তখন দুটো আড়াইটে হবে। দরজা খুলে দেখি, ভারতীয় বিমান বাহিনীর জনপ্রিয় জনসংযোগ অফিসার উইং কমাণ্ডার মালিক। উনি ঘরে ঢুকেই আমাকে বললেন, তুমি যে কি কেলেঙ্কারী করে!
কেন?
আমাকে কুইন্স প্রেস পার্টির চার্জ নিতে হবে। আর যে স্পেশ্যাল প্লেনে এসেছি, সেই প্লেনেই এখুনি মেননকে ফেরত পাঠাতে হবে।
আমি আনন্দে উইং কমাণ্ডার মালিককে জড়িয়ে ধরে বললাম, আপনার দ্বিধা করার কোন কারণ নেই। এই সুখবরটা আমিই মেননকে জানিয়ে আসছি।
উনি হাসতে হাসতে বললেন, মেননের অনেক উপকার করেছ। তোমাকে ওর আর উপকার করতে হবে না।
গভীর রাত্রে মেনন যখন অখোবদনে রামবাগ প্যালেস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে বললাম, বন ভয়েজ, হাপি ল্যাণ্ডিং।
দুপুরবেলায় যিনি বাঘের মত হুঙ্কার দিচ্ছিলেন, এই গভীর রাত্রে তিনিই মুষিকের মত রামবাগ প্যালেস থেকে বেরিয়ে গেলেন।
হ্যাঁ, যে নীহাল সিংকে নিয়ে এতকিছু ঘটল, তিনি কিন্তু নীরব। তাঁর মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। সেদিন থেকে নীহাল সিংকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি।
জয়পুর রাজভবনের লাঞ্চে রাণীর গল্পগুজবের খবর স্টেটসম্যানে ছাপা হয়নি। দিল্লীতে ফিরে শুনেছিলাম, নেহরু নিজে স্টেটসম্যানের সম্পাদক জনসনকে সব জানিয়ে বলেছিলেন, আপনি যা ভাল মনে করেন, তাই করবেন। আদর্শবান সাংবাদিক হিসেবে জনসন ঐ সংবাদ প্রকাশ করা উচিত মনে করেননি।
রাণী এলিজাবেথের সঙ্গে সারা ভারত নেপাল সফরের সময় নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল এবং তার মধ্যে দুটি-একটি অভিজ্ঞতার কথা বোধ হয় সারা জীবনেও ভুলব না।
রাণীর সফরের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক ছিল না। তিনি ও প্রিন্স ফিলিপ প্রায় টুরিস্টের মতই সারা দেশ ঘুরছিলেন। তার সঙ্গে ব্রিটেন ও কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে যথোচিত আদর-আপ্যায়ণ ইত্যাদি।
আমাদের কুইন্স প্রেস পার্টির দিন শুরু হতো সাত-সকালে রাণীর লেডি-ইন-ওয়েটিংয়ের ব্রিফিং দিয়ে। উনি সেই সাত সকালেই আমাদের জানিয়ে দিতেন, সেদিন রাণী কখন কার ডিজাইন ও কোথায় তৈরি করা কি ধরনের পোশাক পরবেন। কখন কি গহনা ব্যবহার করবেন।
এর পর রাণী ও প্রিন্স ফিলিপ, লর্ড মার্লবোরা, শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত প্রভৃতির সঙ্গে প্রাতঃকালীন শুভেচ্ছা বিনিময় করেই আমরা ভিভিআইপি পার্টির সঙ্গে নানা দ্রষ্টব্য দেখতে যেতাম। দুপুরে প্রাইভেট লাঞ্চ। কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার ঘোরাঘুরি। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ককটেল এবং ব্যাংকোয়েট বা বিশেষ ভোজসভা। মোটামুটি এই ছিল সারাদিনের প্রোগ্রাম।
রাণী যখন যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁকে দেখতে আসতেন। পথে-ঘাটে সর্বত্র সব সময় ভীড় হতো। এ তত গেল সাধারণ মানুষের কথা। যারা তথাকথিত গণ্যমান্য বা বিশিষ্ট তাদের মধ্যেও রাণী সম্পর্কে অস্বাভাবিক আগ্রহ দেখতাম। রাণীর কোন না কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য অসংখ্য গণ্যমান্য মানুষের যে হাংলামী দেখতাম, তা ভাবলে অবাক লাগে। রাণীকে একটু কাছ থেকে দেখে বা তাঁর কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তথাকথিত সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বহু ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা এবং মেয়েরা যে কি করতেন, তার পুরো বৃত্তান্ত লিখতেও ঘেন্না হয়। তবু কিছু না লিখে পারছি না।
রাণী আমেদাবাদ থেকে করাচী যান। সেখানে থেকে পূর্ব পাকিস্তানে। সেখান থেকে ফিরে দ্বিতীয় পর্যায়ের ভারত সফর শুরু হয় দুর্গাপুর থেকে। ভারতীয় সাংবাদিকদের পাকিস্তান সরকার ভিসা না দেওয়ায় কুইন্স প্রেস পার্টিকে নিয়ে এয়ার ইণ্ডিয়ার সুপার কনস্টেলেশন বিমানটি রাণী পৌঁছবার আগের দিনই দিল্লী থেকে পানাগড় পৌঁছে যায়। সেখান থেকে দুর্গাপুর।
সেদিন সন্ধ্যায় ও রাত্রে সাংবাদিকদের কোন কাজ ছিল না বলে জমিয়ে আড্ডা দেবার ব্যবস্থা হল। কিছু সাংবাদিক ও টি. ভি. ক্যামেরাম্যান শুধু আড্ডা দিয়ে এমন একটি সন্ধ্যা ও রাত্রি নষ্ট করতে চাইলেন না; তাই ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দুর্গাপুরের এদিক ওদিক আর আসানসোলের আশেপাশে ঘুরতে। কুইন্স প্রেস পার্টির এইসব রসিক সাংবাদিকরা বোধ হয় দুখানা গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। কিন্তু ফিরে এলেন পাঁচ-সাতখানা গাড়ি করে। সে সব গাড়ি বোবাই। হয়ে এলেন দুর্গাপুর-আসানসোল-বার্ণপুর শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু গণ্য মান্য অফিসার ও তাদের স্ত্রী ও বোনেরা। কুইন্স প্রেস পার্টির সদস্যদের সঙ্গে সারা রাত্রি মদ খাওয়া আর নাচ-গান করা কি কম সৌভাগ্যের কথা? ওদের খুশি করলে রাণীকেও খুব কাছ থেকে দেখা যাবে। হয়ত রাণীর সঙ্গে ছবিও উঠতে পারে। এসব কী সব অফিসার ও তাদের স্ত্রী-বোনের ভাগ্যে হয়?
আহা! এই পরম সৌভাগ্য লাভের আশায় কিছু অফিসারের স্ত্রী ও বোনেরা হাসতে হাসতে কিভাবে নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছিলেন।
তবে আরো মজার ঘটনা দেখেছিলাম এক দেশীয় রাজ্যের রাজপ্রাসাদে। রাণী এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপ ভারত সফরে এসে নানা জায়গা ঘুরতে ঘুরতে ঐ দেশীয় রাজ্যের রাজধানীতে এলেন। রাজপ্রাসাদে তাদের সম্বর্ধনার এলাহি ব্যাপার। অনেক অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল রিসেপসন। কুইন্স পার্টির সম্মানে ছিল ককটেল। বিরাট প্রাসাদের কয়েকটি ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ থেকেই রাণী ও প্রিন্স ফিলিপ বিদায় নিয়েছেন। বিদায় নিয়েছেন লর্ড মার্লবোরা, শ্ৰীমতী বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, ব্রিটিশ হাইকমিশনার ও আরো কয়েকজন। আনন্দ উৎসবে আমরাও মেতে আছি। রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে কিন্তু ককটেল চলছে। চলছে নাচগান হৈ-হুঁল্লোড়। রসিকের দল তখনও মত্ত থাকলেও ঘড়ির কাঁটা মাঝ-রাত্তির ছুঁই ছুঁই করছে দেখেই. দু একজন বন্ধুকে নিয়ে পার্টি ছেড়ে বেরুলাম। হঠাৎ মনে হল, দেখি তত অন্যান্য স্বরে কি হচ্ছে। একটি ঘর পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরে ঢুকেই চক্ষু ছানাবড়া। কয়েকজন সুন্দরী যুবতী ও বন্ধু প্রায় উলঙ্গ হয়ে মেঝেয় গড়াগড়ি দিচ্ছেন কিন্তু কয়েকজন অতি রসিক ইংরেজ ও ভারতীয় অফিসাররা চূড়ান্ত প্রমত্ত অবস্থায় তাদের জড়িয়ে রয়েছেন। আহা! সে কি দৃশ্য। বুদ্ধ গান্ধীর দেশের সামান্য মৰ্ত্তবাসী হয়ে অমরাবতী-অলকানন্দর দৃশ্য। দেখে আমি তাজ্জব। একটু এগিয়ে না গিয়ে পারলাম না কিন্তু কাছে যেতেই চমকে উঠলাম। সবাইকে চিনতে পারলাম না কিন্তু দুজন নায়িকাকে দেখেই চিনলাম এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এই দুজন শুধু বাঙালী মেয়েই নন, কলকাতার অতি বিখ্যাত পরিবারের কন্যা ও বধূ! খ্যাতি, যশ, অর্থ, প্রতিপত্তি–সব কিছু এই পরিবারের আছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতবর্ষের নানা দেশীয় রাজ্যের রাজপরিবারের সঙ্গে এদের গভীর হৃদতা আছে। এরা অবশ্যই সেই সূত্র ধরে রাণীর সফর উপলক্ষে কলকাতা থেকে ওখানে গিয়েছিলেন।