যাইহোক কুইন এলিজাবেথের সঙ্গে সারা দেশ ঘোরার সময় কয়েকটা মজার ঘটনা ঘটে। কুইনের সঙ্গে আমরা সত্তর-পঁচাত্তরজন। সাংবাদিক ঘুরছিলাম। তার মধ্যে জনদশেক মাত্র ভারতীয়, বাকি সব সব বিদেশী। তখন দিল্লী-লণ্ডন-দিল্লীর বিমান ভাড়া ছিল তিন হাজারের কিছু বেশি। আর কুইনের সঙ্গে ঘোরার জন্য আমরা এক একজন সাংবাদিক ভারত সরকারকে বিমান ভাড়া বাবদ দিয়েছিলাম প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া হোটেল, খাওয়া-দাওয়া ও স্থানীয় যানবাহনের খরচ বাবদ দিই আরো কয়েক হাজার টাকা। সব টাকাই আগাম দিতে হয়েছিল সরকারকে। বলা বাহুল্য সব সাংবাদিকের জন্যই একই বিধিব্যবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা করা হয়েছিল।
অঘটন ঘটল জয়পুরে।
গুরমুখ নীহাল সিং তখন রাজস্থানের রাজ্যপাল। রাজ্যপালের অন্যতম পুত্র নীহাল সিং স্টেটসম্যানের প্রতিনিধি হয়ে আমাদেরই সঙ্গে কুইন্স প্রেস পার্টিতে ছিলেন। হঠাৎ দুপুরবেলায় রামবাগ প্যালেসে বসে আমরা খবর পেলাম রাজভবনে কুইন ও প্রিন্স ফিলিপের জন্য রাজ্যপাল আয়োজিত প্রাইভেট লাঞ্চে রাজপাল তার পুত্রকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খবরটা যখন এলো তখন লাঞ্চ প্রায় শেষ। খবরটা সব সাংবাদিককেই বিচলিত করল এবং বিচলিত হবার দুটি কারণ ছিল। প্রথমতঃ কুইন্স প্রেস পার্টির সব সদস্যই সমান অধিকার পাবার অধিকারী এবং কোন কারণেই বিশেষ একজন কোন বিশেষ সুযোগ– সুবিধা দেওয়া যেতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ কুইন কোন রাজনৈতিক বক্তৃতাদি দিতেন না বলে অন্য ধরণের বৈচিত্রময় খবরই সাংবাদিকদের পরিবেশন করতে হত। সে ক্ষেত্রে যদি কোন সাংবাদিক একাকুইনের কোন অনুষ্ঠানের কোন ধরণের কথাবার্তা গল্পগুজব তাঁর পত্রিকায় রিপোর্ট করেন, তাহলে অন্য সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের পেশাগত আপত্তি থাকার অবশ্যই কারণ আছে।
যাই হোক হিন্দুস্থান টাইমস্-এর শ্ৰীমতী প্রমীলা কলহান ও আমি খবরটির সত্যাসত্য যাচাই করার জন্য রাজ্যপালের কাছে গেলাম। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে উনি আমাদের বললেন, নীহালকে লাঞ্চে ডেকেছিলুম। তাছাড়া চীফ সেক্রেটারীকে বলেছি, কুইন ও প্রিন্সের সঙ্গে ওকে সাওয়াই মধুপুর ফরেস্ট যাবার ব্যবস্থা করে দিতে।
শুনে আমরা দুজনেই হতবাক। কোন প্রতিবাদ ও তর্ক না করে আমরা ফিরে এসে কুইন্স প্রেস পার্টির ভারপ্রাপ্ত অফিসার মিঃ মেননকে সবকিছু বলে প্রতিকার দাবী করলাম। এখানে বলা প্রয়োজন যে এই অফিসারটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রচার দপ্তরের অধিকর্তা ও একজন অতি বিখ্যাত ভূতপূর্ব রাষ্ট্রদূতের জামা ছিলেন। সাংবাদিকদের তার সঙ্গে অনেক তর্ক-বিতর্ক হল। সব শেষে উনি বললেন, যদি কেউ ভাল পরিবারের ছেলে হয় বা ভাল পারিবারিক যোগাযোগ থাকে, তাহলে তিনি কী করবেন?
ভদ্রলোকের কথার প্রতিবাদ করলেন অনেকেই। আমি ওকে বললাম, আমি গরীব স্কুলমাস্টারের ছেলে। বাপের সুপারিশ বা শ্বশুরমশায়ের কৃপায় আমি কুইল প্রেস পার্টিতে আসিনি বা কোন সুযোগ-সুবিধা চাই না। যাদের নিজেদের উপর আস্থা নেই এবং যারা অকর্মন্য তারাই বাপ-শশুরের নাম ভাঙিয়ে কাজ হাসিল করে।
আমার কথায় ভদ্রলোক তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন।
কুইন্স প্রেস পার্টির সম্মানে মুখ্যমন্ত্রী মোহনলাল সুখাদিয়ার পার্টির সময় হয়ে এসেছিল বলে তর্ক-বিতর্ক ঐখানেই থামল। ঐ পার্টিতে গিয়েই সুখাদিয়াকে সবকিছু বলে জানালাম, একজন সাংবাদিককে বিশেষ সুযোগ দেওয়া ও প্রেস পার্টির ভারপ্রাপ্ত অফিসারের নিন্দনীয় মনোভাবের প্রতিবাদে আমরা কেউ কুইন-এর খবর পাঠাব না। আমরা নেহরুকে সব জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠাব, তাও ওকে বললাম।
সবকিছু শুনে সুখাদিয়া কি খুশি। উনি রাজ্যপালের বিরুদ্ধে অনেক কথা জানিয়ে আমাকে বললেন, টেলিগ্রাম এখুনি টাইপ করে আমাকে দাও। আমি ওয়ারলেস-এ পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আমি মহা উৎসাহে টেলিগ্রাম টাইপ করলাম। প্রেরকদের মধ্যে সবার প্রথমে নাম রইল আমার ও প্রমীলাদির। দুচারজন সাংবাদিক নিজেদের নাম দিতে ভয় পেলেন বলে তাদের নামের উল্লেখ করা হল না।
আমি টেলিগ্রামের কপি সুখাদিয়াকে দিতেই উনি সঙ্গে সঙ্গে চীফ-সেক্রেটারীর হাতে দিয়ে বললেন, এটা এখুনি পুলিশ ওয়ারলেস-এ পাঠিয়ে দিন।
তখন বিকেল সাড়ে চারটে-পাঁচটা হবে।
রিসেপসন-ককটেল-ডিনার ইত্যাদি সেরে আমরা রামবাগ প্যালেসে ফিরলাম অনেক রাত্রে। বোধ হয় বাবোটা-সাড়ে বারোটা হবে। আমি আর আমার রুমমেট ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মিঃ দার জামাকাপড় বদলে শুতে যাচ্ছি, এমন সময় কে যেন দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজ করলেন। দরজা খুলতেই দেখি, একজন আর্মি মেসেজার। উনি সেলাম করে যে সীল করা খামটি দিলেন, সেটা খুলে দেখি প্রাইম মিনিস্টারের টেলিগ্রাম–সব সাংবাদিক সংবাদ সংগ্রহের সমান সুযোগ পাচ্ছেন না জেনে অত্যন্ত দুঃখিত হলাম। যাই হোক ভারত-বৃটেনের মৈত্রীর স্বার্থে ও রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি যথোচিত সম্মান দেখানোর জন্য রাণীর সফরের সংবাদ পরিবেশন বন্ধ না রাখলে অত্যন্ত সুখী হব। ভবিষ্যতে আপনাদের কাজে কোন অসুবিধা হবে না এবং সেজন্য প্রয়োজনীর ব্যবস্থা করছি। আমি আর দার প্রায় দৌড়ে গিয়ে প্রমীলাদিকে সবার আগে খবর দিলাম। স্বাভাবিক ভাবেই একটু হৈ চৈ শুরু হল সাংবাদিকদের মধ্যে।