মানুষের প্রতি এই দরদ, ভালবাসা না থাকলে কি সবার শ্রদ্ধা লাভ করা যায়?
আবার নিরীহ মানুষটি কত স্পষ্ট বক্তা ছিলেন ভাবলেও অবাক হতে হয়। ভারত সফর শেষে রাণী এলিজাবেথ দিল্লী ত্যাগ করার প্রাককালে উনি জানতে পারেন, রাজেন্দ্রবাবু ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হবার কাহিনী নিয়ে একখানা অতি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন। সবিস্ময়ে রাণী এঁকে বললেন, সারা জীবনই নানা কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। এই বই লেখার সময় পেলেন কখন?
রাজেন্দ্রপ্রসাদ নির্বিকারভাবে বললেন, আপনার বাবার জেলখানায় এত দীর্ঘদিন থেকেছি যে এ বই লিখতে কোন অসুবিধে হয়নি।
শুধু রাণী বা প্রিন্স ফিলিপ না, উপস্থিত ভারতীয় অফিসাররাও রাজেন্দ্রবাবুর স্পষ্টবাদিতার প্রমাণ পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
এই ধরণের মানুষ কি আবার রাষ্ট্রপতি হবেন না?
.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর নানা দেশের মানুষকে শিখিয়েছিল যে রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ বিশ্বের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা দেশের মধ্যে নিয়মিত বোগাযোগ রাখেন কূটনৈতিক মিশনের কূটনৈতিকরা কিন্তু সব সময় এই যোগাযোগের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট দেশের ও বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিশ্ব শান্তির স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয় না। যা প্রয়োজন তা হচ্ছে মাঝে মাঝে রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ। সে যোগাযোগ কখনও চিঠিপত্রের মাধ্যমে, কখনও বা ব্যক্তিগত দেখাশুনা-কথাবার্তার দ্বারা।
রাষ্ট্রনায়কদের রাষ্ট্রীয় সফর হয় আরো একটি কারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্র বড় দ্রুত গতিতে বদলাতে শুরু করে। নানা মহাদেশের নানা দেশ একের পর এক স্বাধীন হতে শুরু করে এবং কয়েক বছরের মধ্যেই জন্ম নেয় তৃতীয় বিশ্ব (থার্ড ওয়ার্লড কানট্রিস)। এই তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশই জন্ম নেয় নানা সমস্যার মধ্যে এবং সেসব সমস্যার সমাধানের জন্য এই সব দেশের রাষ্ট্রনায়ক অন্যান্য বহু দেশের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করলেন। প্রধানতঃ এই প্রয়োজনের তাগিদেই শুরু হল অন্য দেশের কর্ণধারদের আমন্ত্রণ জানান।
উন্নতশীল দেশের কর্ণধাররা অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানান আরো একটি বিশেষ কারণে। বহু উন্নতশীল দেশেই গণতন্ত্র নেই, অনেক সময়ই একনায়কত্বের অধিকারীরা নিজেদের ভাবমূর্তি ও ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের রাষ্ট্রীয় সফরে আমন্ত্রণ জানান।
এ ছাড়াও আরো একটি কারণ থাকে রাষ্ট্রীয় সফরের পিছনে। কোন কোন দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানরা অন্য দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সার্টিফিকেট বড় পছন্দ করেন। আবার কিছু কিছু রাষ্ট্রনায়ক অন্য দেশে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়ে নিজের গুরুত্ব বাড়ান।
যাইহোক ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার পর আমাদের রাষ্ট্রনায়করা যেমন রাষ্ট্রীয় সফরে নানা দেশে গিয়েছেন, সেই রকম বহু দেশের রাষ্ট্র নায়করাও আমাদের দেশে এসেছেন রাষ্ট্রীয় সফরে।
এই সব রাজা-রাণী বা প্রেসিডেন্ট-প্রাইম মিনিস্টারকে সাদরে অভ্যর্থনা জানান হয় দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে। দুপক্ষ থেকে দুটি ভাষণে পরস্পরকে মহান বলে উল্লেখ করা, মাননীয় অতিথির স্টেট ড্রাইড রাষ্ট্রপতি ভবনে অভ্যর্থনা, অবস্থান, রাজঘাটে শ্রদ্ধার্ঘ, পার্লামেন্ট বক্তৃতা, কটেজ ইণ্ডাষ্ট্রীজ এম্পোরিয়ামে কিছু অতি মূল্যবান জিনিষপত্র কেনা, রাষ্ট্রীয় ভোজ, কূটনৈতিক সম্বর্ধনা, নাগরিক সম্বর্ধনা ইত্যাদির খবর সব কাগজেই প্রকাশিত হয় ও দেশবাসী জানতে পারেন। কিন্তু এইসব রাষ্ট্রীয় সফরের কিছু নেপথ্য কাহিনী থাকে বা এইসব সফরের সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা কোনদিনই সংবাদপত্রে ছাপা হয় না।
আইসেনহাওয়ার, ক্রুশ্চেভ, বুলগানিন, চু এন লাই, হো চি মীন, কুইন এলিজাবেথ, প্রিন্স ফিলিপ, নাসের, টিটো, সোয়েকৰ্ণ, ভরোশিলভ, জনসন, হারল্ড ম্যাকমিলান, ছারল্ড উইলসন, নক্রমা, উ নু ও আরো অনেক রাষ্ট্রনায়কদের কখনও দূর থেকে, কখনও খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেক রাষ্ট্রপ্রধানদের সফরে আমিও সঙ্গী হয়েছি সাংবাদিক হিসেবে। এইসব সফরের সময় অনেক কিছু জেনেছি, দেখেছি। তার অনেক কিছুই ভুলে গেছি কিন্তু কিছু ঘটনা এখনও মনে আছে।
মনে পড়ছে কুইন এলিজাবেথের সফরের কথা।
নেহরু কিছু কিছু রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়কদের সফরের ব্যাপারে একটু অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে উঠতেন ও তাদের সফর সর্বতোভাবে আনন্দদায়ক ও সাফল্যজনক করার জন্য বিন্দুমাত্র ত্রুটি করতেন না। কুইন এলিজাবেথ ও প্রিন্স ফিলিপের ভারত সফরের আগেও বহু গণ্যমান্য বরেণ্য রাষ্ট্রপ্রধান ও রাষ্ট্রনায়করা দিল্লীর রাষ্ট্রপতি ভবনে থেকেছেন এবং নিঃসন্দেহে ভালভাবেই থেকেছেন। তবুও কুইন এলিজাবেথ আসার আগে নেহৰু অতি উৎসাহী হয়ে তাদের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনের ঘরগুলি নতুন করে সাজাবার হুকুম দিলেন। মহীশূর থেকে চন্দন কাঠ এনে নতুন খাট তৈরি হল। প্যানেলিংও হল চন্দন কাঠের। বাথরুম। কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে পৃথিবীর আধুনিকতম ও সর্বাধিক মনোরম ব্যবস্থা করা হল। শুধু তাই নয় ঘরগুলির পুরানো আসবাবপত্র, পেন্টি, সিল্কের পর্দা সরিয়ে সবকিছু নতুন করা হল। এক কথায় এলাহি ব্যাপার। জ্যাকুলিন কেনেডি যখন দিল্লী সফরে এসে তিনমূর্তি ভবনে ছিলেন, তখন তাঁর জন্যও অনুরূপ এলাহি ব্যাপার হয়।