অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক হল, রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত মোহরাঙ্কিত ফ্রেমে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর করা ছবি দেওয়া হবে প্রত্যেকটি শিল্পীকে এবং এই সিদ্ধান্ত হল স্বয়ং ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সুপারিশে। মেজর জেনারেল সিং প্রস্তাবটি মেনে নিলেও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা এই উপহার বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও ভারতস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের দিয়ে থাকি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে বললাম, জেনারেল, আর্টিস্ট লাইক পঙ্কজ মল্লিক এ্যাণ্ড আদার্স আর নো লেস রেসপেকটেবল দ্যান দেম।
ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দ্যাটস রাইট। পঙ্কজ ইজ পঙ্কজ।
আর একটি শব্দ উচ্চারণ না করে মেজর জেনারেল সিং রাষ্ট্রপতিকে স্যলুট করে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলেন।
উনি বেরিয়ে যাবার পর পরই ভক্টর রাধাকৃষ্ণণ একজন শিল্পীর নাম করে জিজ্ঞেস করলেন, ও আসছে তো?
হ্যাঁ, উনিও আসছেন।
ও আমাকে গান শোনাবে তো?
আমি হেসে বললাম, নিশ্চয়ই শোনাবেন।
এবার ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ নিজে থেকেই বললেন, ও সত্যি অত্যন্ত উঁচুদরের শিল্পী।
আমি বললাম, হ্যাঁ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এবার রাষ্ট্রপতি বললেন, মাঝে মাঝে ভাবি ইউনেস্কো সেক্রেটারি জেনারেলকে বলব, প্যারিস হেডকোয়ার্টার্সে ওর একটা প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করতে।
শুনে এত আনন্দ হল যে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না কিন্তু আমার সে আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। মেজাজ ভাল নেই বলে ঐ শিল্পী রাষ্ট্রপতি ভবনের সম্বর্ধনা সভায় গেলেন না। আমি মনে মনে বুঝলাম, গ্রামে-গঞ্জে প্যাণ্ডেলে গান গেয়ে মোটা টাকা পেয়ে পেয়ে ওদের রুচিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে আমি ডক্টর রাধাকৃষ্ণণকে বললাম, হঠাৎ ওর শরীর খারাপ হয়ে পড়ায় উনি আসতে পারলেন না।
পরে একদিন ভক্টর রাধাকৃষ্ণণ আমাকে বলেছিলেন, বাঙালী শিল্পীরা যদি বোম্বে-মাদ্রাজের শিল্পীদের মত ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন ও পাঁচজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাহলে তাঁদের অনেকের খ্যাতিই বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত বাট নাইকার দে উইল বী সোস্যাল নর দে লাইক টু লার্ণ ইংলিশ।
০৬. ভারতবর্ষের প্রথম নাগরিক
ভারতবর্ষের প্রথম নাগরিকই রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রধান আবাসিক। সেই উনিশ শ বাহান্ন সালে চাকর রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই প্রাসাদে ঢোকেন। তারপর কতজনেই রাষ্ট্রপতি হলেন।
গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে কোন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকার দেয়নি কিন্তু দিয়েছে অকল্পনীয় সম্মান। সমগ্র রাষ্ট্রের তিনি প্রতীক। তাঁরই নামে চলে সরকার। স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর তিনিই সর্বাধিনায়ক। তাঁরই আমন্ত্রণে সংখ্যা-গরিষ্ঠ দলের নেতা হন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীদের সংবিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ ও মন্ত্রগুপ্তি নিতে হয় এই রাষ্ট্রপতির কাছেই। সুপ্রীম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিরা তাঁরই কাছ থেকে নিয়োগপত্র পান। রাষ্ট্রদূতরাও তাই। ভারতস্থ বিদেশী রাষ্ট্রদূতরাও তাঁদের পরিচয়পত্র রাষ্ট্রপতির করকমলে সমর্পণ করে কাজ শুরু করেন। আরো কত কি। ক্ষমতা না থাক, এই সম্মানের কি মূল্য নেই? যাকে-তাকে কি এই সম্মান দেওয়া যায়? নাকি উচিত?
ষাট-সত্তর কোটি ভারতবাসীর পরম সৌভাগ্য প্রথম দিকে এমন এক একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, যাদের নিয়ে গর্ব করা যায় কিন্তু পরবর্তীকালে এমন এক একজনকে এই অভূতপূর্ব সম্মান পাবার অধিকার দেওয়া হয়েছে, যাদের কীর্তি কাহিনী জানলে সমস্ত ভারতবাসী মাথা হেঁট করবেন।
এমন এক ব্যক্তি একবার রাষ্ট্রপতি হলেন, যার সীমাহীন দৈন্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। দিল্লীতে এই ভদ্রলোকের অনেক আত্মীয়-স্বজন ছিল। তারা চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। থাকতেন নিজেদের আস্তানাতেই কিন্তু সেসব বাড়িতে রান্নাবান্নার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ঐ ভদ্রলোক যখন রাষ্ট্রপতি তখন রাষ্ট্রপতি ভবনের গাড়ি ছুটে বেড়াতে সারা দিল্লী। ঐসব গাড়ি করে রাষ্ট্রপতির আত্মীয়-স্বজনরা প্রতিদিন সকালেসন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে এসে সরকারী তহবিলের সর্বনাশ করে খাওয়া-দাওয়া করতেন।
রাষ্ট্রপতি ভবন সংলগ্ন জমিতে শুধু ফুলের বাগানই নেই, চাষ হয় অনেক কিছুর। ধান-গম থেকে আলু-পটল-পেঁয়াজ-টমাটো। আমরা কত কি। এসব চাষ হয় রাষ্ট্রপতি ভবনের প্রয়োজনেই কিন্তু ঐ মহাপুরুষটি এইসব আলু-পেঁয়াজ দেশের বাড়িতে নিয়ে যেতেন নিয়মিত।
রাষ্ট্রপতি ভবনের সবাই এ খবর জানতেন কিন্তু বাইরের কেউ রাষ্ট্রপতির এই লোভের কথা জানতেন না। কথায় বলে, চোলে, জ দিল, গোর একদিন।
রাষ্ট্রপতি সপরিবারে নিজের দেশে যাবেন। দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিশেষ বিমানটি দাঁড়িয়ে। ম্যামপ-এর পাশেই কমাণ্ডার অব দ্য এয়ার ক্রাফট ও অন্যান্য বিমান কর্মীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসার ও পুলিশ অফিসাররাও রাষ্ট্রপতির জন্য অধীর প্রতীক্ষায়।
নিয়ম অনুযায়ী ভি-আই-পি কনভয়ের আগেই এলো মালপত্র। রাষ্ট্রপতি ও তাঁর পরিবার এবং রাষ্ট্রপতির সহযাত্রী রাষ্ট্রপতি ভবনের অফিসার ও কর্মীদের মালপত্র বিমানে ভোলা শুরু হল। প্রায় সব মাল উঠে গেছে। এমন সময় কয়েকটা বস্তা তুলতে গিয়েই বিভ্রাট। হঠাৎ একটা বস্তা বিমানের দরজার কাছ থেকে মাটিতে পড়লেই কয়েক মণ পেঁয়াজ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।