খানিকটা প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম এইটুকু বলার জন্য যে এই বিখ্যাত সাংবাদিকের অতি উৎসাহের ফলেই বিদেশের মানুষকে জানানো হয়–লালবাহাদুর শাস্ত্রী সাক্ষীগোপাল মাত্র : আসল কলকাঠি নাড়ছেন সিণ্ডিকেটের কয়েকজন নেতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এমন অসহায় অবস্থার খবর জানতে পেরে মহা খুশি হলেন পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক আয়ুব খান।
আয়ুব খান নেহরুহীন ভারতের মহাদুর্দিনে ভারতকে শিক্ষা দেবার জন্য খুব বেশি সময় নষ্ট করলেন না। অমুল্য তৈল সম্পদে সমৃদ্ধ রাণ অব কচ্ছে, আয়ুব খানের তাঁবেদারী সৈন্যবাহিনী মার্কিন ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে এলো বেশ কিছুটা। গর্জে উঠলেন লালবাহাদুর। হুসিয়ার করে দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিঙেট জনসনকে। বহু বাধা অতিক্রম করে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে গেল রাণ অব কচ্ছের দিকে।
থমকে গেলেন আয়ুব খান কিন্তু দুর্বল ভারত সরকারকে শিক্ষা দেবার লোভ সম্বল করতে পারলেন না। সাতচল্লিশ সালের নভেম্বর মাসে জিন্না সাহেব যেমন রাজাকার পাঠিয়ে কাশ্মীর ছিনিয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, আয়ুব খান ঠিক অনুরূপ প্রচেষ্টা করুতেই দুর্বল প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। শাস্ত্রীজির জয় জওয়ান, জয় কিষাণ মন্ত্রে ষাট কোটি ভারতবাসী উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল।
এর পরের কাহিনী সবার জানা আছে। যা জানা নেই তা হচ্ছে এই যে, ঐ সাক্ষীগোপাল ও দুর্বল লালবাহাদুরের দুর্জয় সঙ্কল্প ও অভাবনীয় নেতৃত্বের পরিচয় পেয়ে শুধু আয়ুব খান না, সিণ্ডিকেটের কেষ্ট-বিধুরাও ঘাবড়ে গেলেন। দিল্লীতে বসে ফোপর দালালী করার সুযোগ নেই দেখে অনেক নেতাই দীর্ঘ কয়েক মাস পর স্ব স্ব রাজ্যে ফিরে গেলেন। শুরু করলেন দেশরক্ষা তহবিলের জন্য অর্থ ও জিনিসপত্র সংগ্রহ। কংগ্রেস নেতাদের সে কী উৎসাহ! খরা, বন্যা, নির্বাচন আর যুদ্ধের সময় অনেক নেতাই এমন জনদরদী ও কাজপাগল হয়ে ওঠেন, যা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এমন মওকায় নেতারা কেন দেশ ও দশের সেবায় পাগল হয়ে ওঠেন, তা কে না জানে?
.
যাই হোক, যুদ্ধ বিরতি হবার কদিন পরই শাস্ত্রীজি একদিন আমাকে বললেন, তোমার সঙ্গে তো অনেক গায়কের পরিচয় ও বন্ধুত্ব আছে। তুমি ওদের এনে একটা অনুষ্ঠান করে কিছু টাকা তুলছ না কেন?
শাস্ত্রীজির অনুপ্রেরণাতেই ঐতিহাসিক বিজ্ঞান ভবনে দুদিনের বাংলা সঙ্গীত সম্মেলন করলাম। (এর আগে বিজ্ঞান ভবনে কোন সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়নি।) প্রায় সমস্ত বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা বিন পারিশ্রমিকে এই সম্মেম্বনে যোগ দিলেন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করলেন। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী প্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করতেই উনি এই সম্মেলনের গান রেডিও থেকে সাত ঘণ্টা প্রচার করার ব্যবস্থা করলেন। শিল্পীদের ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ বাসভবনে আপ্যায়িত করলেন প্রধানমন্ত্রী, শ্ৰীমতী গান্ধী, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মিঃ চাগলা, দেশরক্ষা মন্ত্রী চ্যবন ও আরো অনেকে। সর্বোপরি শিল্পীদের সম্বর্ধনা হল রাষ্ট্রপতি ভবনে। সেই কাহিনী বলতে গিয়েই কত কি মনে পড়ল। খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও তাই এই সব না লিখে পারলাম না।
যাই হোক, একদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে ডক্টর রাধাকৃষ্ণণকে সম্মেলনের বিষয়ে সবকিছু জানার পর বললাম, একসঙ্গে এত গুণী বাঙালী শিল্পীর সমাবেশ কখনও দিল্লীতে হয়নি। সুতরাং আপনার এখানে একটা কিছু অনুষ্ঠান হওয়া উচিত বলে মনে হয়।
বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় হাসতে হাসতে উনি বললেন, তোমার মাথায় যখন ঢুকেছে তখন কিছু তো না করে উপায় নেই।
সঙ্গে সঙ্গে মিলিটারী সেক্রেটারি মেজর জেনারেল সিংকে ডেকে বললেন, মুন, নিমাই কি বলছে।
আমি আমার বক্তব্য বলতেই মেজর জেনারেল সিং রাষ্ট্রপতিকে বললেন, স্যার, অত শিল্পীর গান শোনার সময় কী আপনার হবে।
ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ হাসতে হাসতে বললেন, একে নিমাই-এর ব্যাপার, তার ওপর এতজন গুণী শিল্পী আসবেন। সময় আমাকে দিতেই হবে।
দিনক্ষণের ব্যাপারে কথাবার্তা বলার পর মেজর জেনারেল সিং রাষ্ট্রপতিকে বললেন, স্যার, শিল্পীদের লীডারকে শ পাঁচেক টাকার তোড় দিলেই হবে তো?
ফর দ্যাট কনসাল্ট নিমাই।
মেজর জেনরেল সিং আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি বললাম, না, তা হতে পারে না। ওরা প্রত্যেকেই গুণী শিল্পী। জনাবিশেক শিল্পীকে কী ঐ টাকা ভাগ করে দেয়া যায়?
মোট হাজারখানেক দিলে তো হবে?
না, তাও হবে না। আমি আরো বললাম, শিল্পীরা রাস্ট্রপতির আশীর্বাদ পেলেই ধন্য হবে। তাঁদের আর কিছু চাই না।
মেজর জেনারেল সিং কলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট তো ফ্রি সার্ভিস নেন না।
আমি ডঃ রাধাকৃষ্ণণের সামনেই বললাম, কিন্তু তাই বলে তো তারা এখানে অপমানিত হতে আসবে না। তাদের প্রত্যেককে শপাঁচেক করে দিতে পারেন না?
তাহলে তো হাজার দশেক টাকার দরকার। না, না, অত টাকা দেয়া সম্ভব নয়।
তাহলে অল্প কিছু দিন। আমি বেশ জোরের সঙ্গে বললাম, যাই দেওয়া হোক, তা প্রত্যেকটি গায়ক ও তবলচীকে দিতে হবে।
হোয়াই তবলচী? ফোঁস করে উঠলেন মেজর জেনারেল। আমি একটু মৃদু হেসে বললাম, তারাও গুণী শিল্পী।