ঢুকলাম আমার এক শুভাকাঙ্গী জয়েন্ট সেক্রেটারির ঘরে। ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা, তাহলে চৌ-এন-লাই আসছেন?
উনি অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, তুমি কি করে জানলে?
কি করে জানলাম, তা আর বলে লাভ কি? তবে চৌ-এন-লাই এর সফর সফল না হলে কি হবে?
লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট!
আচ্ছা চলি দাদা।
আমি পাগলের মত ছুটে গেলাম সি-টি-ও-র প্রেস রুমে। সঙ্গে সঙ্গে টাইপ করতে শুরু করলাম, চাইনীজ প্রিমিয়ার চৌ-এন-লাই ইজ সর্টলি কামিং টু ইণ্ডিয়া টু হ্যাভ টকস উইথ প্রিমিয়ার নেহরু….
জাপানের Kyodo নিউজ এজেন্সীর বিশেষ সংবাদদাতা মিঃ শিমীজু পাশের টেবিলে টাইপ করছিলেন। প্রেস রুমে আর কেউ ছিলেন না। উনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়াত আর ইউ তাইপিং?
আমি হেসে বললাম, দেখে যাও।
মিঃ শিমীজু টাইপরাইটারে আমার কপি দেখেই লাফ দিয়ে উঠলেন, নো নো, নট পসুবুল। এ হতেই পারে না, অসম্ভব। আজও পার্লামেন্টে নেহরু বলেছেন, নো তক্স উইথ চায়না আর তুমি….
আমি মৃদু হেসে বললাম, আমার খবর ঠিক। তুমি ইচ্ছা করলে এই খবর পাঠাতে পারো; তবে আর কাউকে বলবে না।
নো নন, আই কান্ত। এ খবর আমি পাঠাব না।
পরের দিন দুপুরে মিঃ শিমীজু জিজ্ঞাসা করল, তোমার খবর বেরিয়েছে?
হ্যাঁ।
দু একদিন পর ও আমাকে বলল, আমি যদি তোমার কাগজকে কোট করে এই খবরটা পাঠাই, তাতে কি তোমার সম্পাদক আপত্তি করবেন?
না।
তাহলে আমি খবরটা পাঠাচ্ছি।
পাঠাও কিন্তু আর কাউকে বোলো না।
নো নো, নেভার।
ঠিক তার পরের দিন লোকসভার কোশ্চেন আওয়ার শেষ হবার পরই স্পীকার অনন্তশয়নম আয়েঙ্গার ঘোষণা করলেন, প্রাইম মিনিস্টার টু মেক এ স্টেটমেন্ট। নেহরু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন, আই এ্যাম গ্ল্যাড টু ইনফর্ম দ্য হাউস দ্যাট প্রিমিয়ার চু-এন-লাই হ্যাজ কাইলি এ্যাকসেপ্টেড মাই ইনভিটেশন….
আমি প্রেস গ্যালারীর এক কোণায় বসে ছিলাম। নেহরুর তিন চার লাইনের বিবৃতি শেষ হতেই মিঃ শিমীজু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মত আমার সারা মুখে চুমু খেলেন।
আসল ব্যাপার হল এই যে Kyodo’র টোকিও অফিস থেকে খবরটি প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিশ্বের কয়েকটি রেডিও স্টেশন থেকেও এই সংবাদ বলা হয়। এইভাবে খবরটি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবীর নানা রাজধানীতে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। Kyodoর খবর দিল্লী ও চীনের রাজধানীতে পৌঁছতেই দুটি সরকার ঠিক করেন, এই ব্যাপারে অবিলম্বে সরকারী ঘোষণা করাই যুক্তিযুক্ত হবে।
এই চাঞ্চল্যকর খবরটি আগে দিতে পেরেছিলাম বলে সম্পাদক আমার মাইনে বাড়িয়ে দিলেন।
***
সে সময় আমি একই সঙ্গে বাংলা হিন্দী গুজরাতি ও মারাঠী দৈনিকের রাজনৈতিক সংবাদদাতার কাজ করতাম রাজধানী দিল্লীতে। তাই ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হত। পার্লামেন্ট চললে তো কথাই নেই। সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সারাটা দিনই পার্লামেন্টে কাটাতাম। শুক্রবার সকালে প্রশ্নোত্তরের সময় না গেলেও জিরো আওয়ার-এর সময় নিশ্চয়ই প্রেস গ্যালারীতে হাজির হতাম।
শুক্রবারে ঐ জিরো আওয়ার শেষ হতে না হতেই পার্লামেন্টে উইকএণ্ডের হাওয়া বইতে শুরু। শুক্রবার পার্লামেন্টের অর্ধেক সময় বেসরকারী প্রস্তাব ও বিল নিয়ে আলোচনা হয় বলে অনেকেই সে সময় উপস্থিত থাকেন না।
ঐ শুক্রবার বিকেল থেকে রবিবার রাত্রি বা সোমবার সকাল পর্ষন্ত অনেক মন্ত্রীই দিল্লীর বাইরে যান। যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় আমি কোন না কোন ভি. আই. পির সঙ্গে এয়ার ফোর্সের স্পেশাল প্লেনে ঘুরতাম ভারতবর্ষের এখানে-ওখানে। এর ওপর বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতি ও ঘটনার সংবাদ সংগ্রহের জন্যও আমাকে প্রচুর ঘুরতে হত দেশে ও বিদেশে।
প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই কোন সম্পাদককে কিছু না জানিয়েই কলকাতা চলে এলাম, কিন্তু লাভ হল না। দুদিন পরেই আমাকে বোম্বে মেলে চড়তে হল রায়পুর কংগ্রেস অধিবেশন কভার করার জন্য। আগেই ঠিক করেছিলাম প্রকাশ্য অধিবেশনে নেতাদের বক্তৃতা শুনব না। তাই প্রকাশ্য অধিবেশনের দিনের নাগপুরের স্পেশ্যাল ট্রেনেই রিজার্ভেশন করলাম।
স্টেশনে এসে ভারী মজার কাণ্ড হল। আমি রিজার্ভেশন চার্ট দেখে নির্দিষ্ট ফোর-বার্থ কামরার একটা লোয়ার বার্থ দখল করলাম। একটু পরেই এস. কে. পাতিল, কে. ডি. মালব্য ও আরো কয়েকজন নেতা আমারই বগীর অন্যান্য কামরায় উঠলেন। ওদের কাছেই শুনলাম, এই বগীটি জি, টি, এক্সপ্রেসের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ সোজা দিল্লী। খবরটায় সত্যি খুশি হলাম।
খানিকক্ষণ পরে লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক আমার কামরায় এসে বললেন, হাউ কুড ইউ বী হিয়ার? দিস কম্পার্টমেন্ট ইজ রিজার্ভড, ফর ইউনিয়ন প্ল্যানিং মিনিস্টার গুলজারীলাল নন্দা।
আমি একটু অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম, ভুল কামরায় উঠেছি নাকি? বললাম, জাস্ট এ মিনিট! আই উইল চেক আপ ওয়ান্স এগেন।
আমি তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্মে নেমে আবার রিজার্ভেশন চার্ট দেখলাম। আমার টিকিটের নম্বরের সঙ্গে খুব ভাল করে মিলিয়ে দেখলাম, না, ভুল করিনি। নির্দিষ্ট বগীর ঠিক কামরাতেই উঠেছি। আমি আমার কামরায় ফিরে এসে ভদ্রলোককে বললাম, এখানেই আমার রিজার্ভেশন।