এরই মধ্যে আমার আর ভাটিয়ার সকাতর প্রার্থনা, মাস্টারজী, শুধু বলুন কি কি বিষয়ে কথা হল? প্রাইম মিনিস্টারকে দেখে মনে হল, আপনার সঙ্গে কথা বলে উনি খুব খুশি। আপনিও কি খুশি?
উকিলবাবু বলেন, না না, এখানে কিছু বলা হবে না। মাস্টারজী উইল মেক এ স্টেটমেন্ট ওনলি অন এ্যারাইভ্যাল এ্যাট পালাম।
ভাটিয়া মাস্টারজীর পদসেবা করতে করতেই আবার আবেদন জানায়, সব কথা তো জানতে চাইছি না! শুধু বলুন, প্রাইম মিনিস্টারের মনোভাব কেমন দেখলেন?
আমিও মাস্টারজীর সেবা করতে করতে কিঞ্চিৎ তৈলমর্দন করলাম কিন্তু উকিলবাবু ফোঁস করে উঠলেন, নো নো, উই কাণ্ট সে এনিথিং হিয়ার।
বোধহয় আমাদের সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে হঠাৎ মাস্টারজী বললেন, ভকিলসাব, আমি পণ্ডিতজীর সঙ্গে কথা বলে যে স্টেটমেন্ট তৈরি করেছি, তার দুটো কপি এদের দিন।
উকিলবাবু টুঁ শব্দটি না করে আমাদের হাতে বিবৃতির দুটি কপি দিতেই আমরা মাস্টারজীকে ধন্যবাদ দিয়েই এক দৌড়।
সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনে সময় সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। যে সাংবাদিক যত আগে সঠিক সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন করতে পারেন, তার কৃতিত্ব তত বেশি। সেদিন আমি আর সুদর্শন ভাটিয়া প্রধানমন্ত্রী ও মাস্টার তারা সিং-এর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার খবর দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছবার ঘণ্টা চারেক আগে সংগ্রহ করে সত্যি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিলাম।
***
এই সংবাদ সংগ্রহের কাহিনী লিখতে লিখতে আরো একটা কাহিনী মনে পড়ল। ১৯৫৯-১৯৬০। শান্ত স্নিগ্ধ হিমালয়ের এখানে-ওখানে কখনও কখনও বারুদের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। হিন্দী-চীনী ভাই-ভাই আর শোনা যাচ্ছে না। ছোটখাট ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পার্লামেন্টে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আকশাই-চিন এলাকায় চীনের রাস্তা তৈরি ও নেহরুর বিখ্যাত উক্তি নট এ ব্লেড অফ গ্রাস গ্রোজ দেয়ার নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই।
এরই পটভূমিকায় লোকসভা-রাজ্যসভায় নিত্যই প্রশ্নোত্তর। বাদ-প্রতিবাদ। বিরোধীদের খুশি করার জন্য নেহরু বার বার ঘোষণা করছেন, না না, চীনের সঙ্গে কোন আলোচনা নয়।
সেদিন সকালেও লোকসভায় নেহরু বললেন, না, চীনের সঙ্গে কোন আলোচনার কথা আমরা ভাবছি না। পার্লামেন্টের খবর পার্লামেন্ট হাউস পোস্ট অফিস থেকে টেলিগ্রাম করে আমার সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দেবার পর সেন্ট্রাল হলের আড্ডাখানায় চলে গেলাম। তারপর বিকেলের দিকে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম সাউথ ব্লকে দেশরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেননের কাছে। কফি খেতে খেতে আমরা কথা বলছিলাম। হঠাৎ মেনন হাসতে হাসতে বললেন, আমার এখানে আড্ডা দিয়ে তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট না করে প্রাইম মিনিস্টারের অফিসের ওদিকে গিয়ে ভাল খবর জোগাড় করার চেষ্টা কর।
পার্লামেন্টে অভূতপূর্ব উত্তেজনার পর কৃষ্ণ মেননকে ঐভাবে হাসতে ও ঠাট্টা করতে দেখে খটকা লাগল। সন্দেহ হল, তবে কি সত্যি কিছু ঘটতে চলেছে?
আমি উঠে পড়লাম। মাঝখানের করিডর দিয়ে পশ্চিমের দিকে এগুতে এগুতে নানা কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, কি ঘটতে পারে? কি ঘটা সম্ভব? এমন কি ঘটতে চলেছে যা বর্তমান পরিস্থিতিতেও মেননকে খুশি করতে পারে? সীমান্ত-বিবোধ নিয়ে কিছু ঘটছে নাকি?
সাউথ ব্লকের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছতেই দেখি, ফরেন সেক্রেটারি ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দু-তিনজন জয়েন্ট সেক্রেটারি নেহরুর ঘরে বারবার যাতায়াত করছেন। সবাই ব্যস্ত-ত্রস্ত ভাবে ছোটাছুটি করলেও কারুর মুখেই কোন উৎকণ্ঠার ছাপ দেখলাম না। তবে কি এমন কিছু ঘটল যার জন্য সবাই খুশি?
কয়েক মিনিটের মধ্যেই নেহরু হাসি মুখে ফরেন সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়েও ওঁরা দু-এক মিনিট কথা বললেন। ফরেন সেক্রেটারি দু একটা ফাইল হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে নিজের ঘরের দিকে এগুলেন। নেহরু নিচে নামার জন্য দু-এক পা এগুতেই আমাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন তুমি এখানে কেন?
আমি হাসতে হাসতে বললাম, শুনলাম খুব জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ খবর পাবার সম্ভাবনা আছে তাই চলে এলাম।
নেহরু লিফট-এর পরিবর্তে সিঁড়ি দিয়েই নিচে নামতে নামতে প্রশ্ন করলেন, তোমাকে কে বললেন?
সংবাদের সূত্র কি প্রকাশ করা উচিত?
দ্যাটস রাইট।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারও নিচে নামছিলেন। হাতে বিশেষ সময় ছিল না। তাই আমি আর সময় নষ্ট না করে বললাম, আজ আপনি এত খুশি কেন?
নেহরু পাশ ফিরে অফিসারদের দিকে তাকিয়ে চাপা হাসি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, আজ আমাকে খুশি দেখাচ্ছে নাকি?
প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নে অফিসাররা শুধু হাসেন।
সিঁড়ির প্রায় নিচের ধাপে পৌঁছেছি। দু-চার পা এগিয়েই গাড়ির সামনে পৌঁছবেন। আমি আবার প্রশ্ন করি, নিশ্চয়ই কোন ভাল খবর পেয়েছেন?
পেয়েছি বৈকি।
কি সেই ভাল খবর?
তোমাকে বলব কেন?
আপনার ভাল খবর মানে তো সারা দেশের ভাল খবর।
তারপর নেহরু গাড়ির মধ্যে ঢোকার আগে শুধু বললেন, হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু আসছেন বলে আমি খুশি।
কে সেই বন্ধু?
নেহরু আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাসতে হাসতে ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি চালাও।
কৃষ্ণ মেননের ইঙ্গিত আর নেহরুর কথা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, এমন কেউ আসছেন, যার আগমনের ফলে হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান হতে পারে। নেহরু চলে গেলেও আমি সাউথ ব্লক ছেড়ে এলাম না। আবার ওপরে উঠলাম। ভাবলাম, আবার কৃষ্ণ মেননের কাছে যাই। দোতলায় উঠতেই চায়না ডেস্কের ইন-চার্জ জয়েন্ট সেক্রেটারি আর চীফ অব প্রটোকলকে একসঙ্গে ফরেন সেক্রেটারির ঘরে ঢুকতে দেখেই হঠাৎ আমার মনে হল, তবে কি চীন থেকেই কেউ আসছেন? নেহরু যে বন্ধুর কথা বললেন, তিনি কী চীনের প্রধানমন্ত্রী?