চারুবাবু সারাদিনের সব ঘটনা বলতেই. পি. এ. পাশের ঘরে চলে গেলেন।
আমি ন্যাকামী কবে বললাম, আমাকে যদি কিছু বলতেন তাহলে…
আমাকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়েই চারুচন্দ্র বিশ্বাস আবার বললেন, আই এ্যাম আণ্ডার ওথ। আমি কিচ্ছু বলতে পারব না।
আমি অতি কষ্টে হাসি চেপে বললাম, তাহলে আমি যাই।
হ্যাঁ এসো।
আমি নমস্কার কবে ওঁর ঘব থেকে বেরুতেই হেসে ফেললাম।
***
খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। আমিও হয়েছি কিন্তু নিঃসন্দেহে স্বীকার করব, অনেক ঘটনাই ভুলে গেছি। তবু কিছু মনে আছে। এই প্রসঙ্গে মাস্টার তারা সিং-এর কথা মনে পড়ছে।
১৯৪৭ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী এটলি ঘোষণা করলেন, পনেরো মাসের মধ্যে (জুন, ১৯৪৮) ভারত বর্ষে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবেই। লর্ড মাউন্টব্যাটেন দিল্লীতে পৌঁছুলেন ২২শে মার্চ। শপথ নিলেন ২৪শে মার্চ। মাউন্টব্যাটেন দিল্লীতে পৌঁছবার তিয়াত্তর দিনের মধ্যেই ঘোষণা করলেন, ভারত দ্বিখণ্ডিত হবে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্লান্ত ও বৃদ্ধ সেনাপতিরা জীবনের শেষ অধ্যায়ে দিল্লীর তখৎ-এ-তাউস দখলের নেশায় এমনই মশগুল হয়ে উঠেছিলেন যে তাঁরাও ভারত দ্বিখণ্ডিকরণের প্রস্তাব মেনে নিলেন। মাউন্টব্যাটেনের এই সর্বনাশা ঘোষণার ঠিক বাহাত্তর দিন পরে ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হল।
মাউন্টব্যাটেনের এই তাড়াহুড়োর জন্যই র্যাডক্লিফ সাহেব কোন মতে কেটেকুটে দু টুকরো করলেন পাঞ্জাব আর বাংলাকে। দেশ স্বাধীন হবার কয়েক বছরের মধ্যেই দাবী উঠল, পাঞ্জাবী সুবা চাই। ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের সময় এই দাবী অগ্রাহ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার বার বার বললেন, ঐ এক টুকরো রাজ্যকে প্রায় দু টুকরো করার কোন যুক্তি নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব যত কঠোর হয়েছে, মাস্টার তারা সিং-এর নেতৃত্বে পাঞ্জাবী সুবার দাবীও তত তীব্র হয়েছে।
১৯৬০ সালের শেষের দিকে মাস্টার তারা সিং পাঞ্জাবী সুবার দাবীতে আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠল। এই পরিস্থিতির পটভূমিকায় শুরু হল ভবনগর কংগ্রেস অধিবেশন।
.
কংগ্রেস অধিবেশনের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনের কথা। মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির পর অপরাহ্নকালীন অধিবেশন শুরু হবার কয়েক মিনিট বাকি। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ভবনগরের মহারাজার রোলস রয়েস এসে থামল। আস্তে আস্তে লাঠিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে এলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ। সঙ্গে তাঁর পার্সোন্যাল সেক্রেটারি জানকীবাবু। আমাকে দেখেই পন্থজী জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে কি করছ?
হেসে বললাম, এমনি দাঁড়িয়ে আছি।
এবার পন্থজী একটু হেসে বললেন, ওদিকে যে অনেক কিছু ঘটে গেল।….
তার মানে?
পন্থজী একটু চাপা গলায় বললেন, প্রাইম মিনিস্টারের কাছে মাস্টার তারা সিং এসেছেন।
খবরটা শুনেই আমি ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলাম, মাস্টার তারা সিং কখন এলেন?
পন্থজী আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, আর সময় নষ্ট করে তাড়াতাড়ি যাও; তা নয়তো দেখা হবে না।
পন্থজী আর দাঁড়ালেন না। অধিবেশনে যোগ দিতে ভিতরে চলে গেলেন।
জানকীবাবুকে প্রশ্ন করতেই জানতে পারলাম, প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অনুরোধেই মাস্টারজী এসেছেন ভারতীয় বিমান বাহিনীর এক বিশেষ বিমানে। বিমানটি ভবনগর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছে এবং মাস্টারজীকে নিয়ে বিমানটি একটু পরেই দিল্লী রওনা হবে।
…এ তো দারুণ খবর! হেডলাইন স্টোরি!
জানকীবাবুর সাহায্যে কংগ্রেসের একটা জীপ পেলাম। জীপ স্টার্ট দিতেই হঠাৎ কোথা থেকে এসে লাফ দিয়ে উঠল হিন্দুস্তান টাইম-এর বিশেষ সংবাদদাতা সুদর্শন ভাটিয়া।
বিরাট এলাকা নিয়ে ভবনগরের রাজপ্রাসাদ। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি, চারপাশে অজস্র গাছপালা। কোথাও বা সুন্দর ফুলের বাগান, সবুজ মাঠ। অনেকগুলি ছোট-বড় প্রাসাদ। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর যখন আসল রাজপ্রাসাদের সামনে হাজির, তখন দেখি নেহরু মাস্টার তারা সিংকে বিদায় জানাতে বেরিয়ে এসেছেন। ইতিমধ্যে আমরা দুজনে হাজির। অবিলম্বে কংগ্রেস অধিবেশনে যেতে হবে বলে নেহরু মাস্টারজীকে বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই চলে গেলেন কিন্তু যাবার আগে আমাদের দুজনকে দেখিয়ে ঠাট্টা করে বললেন, নাউ দে উইল লুক আফটার ইউ।
বৃদ্ধ ক্লান্ত মাস্টারজী একটা চেয়ারে বসলেন; পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন ওঁর সঙ্গী এক উকিলবাবু। আমি আর সুদর্শন ভাটিয়া প্রায় একসঙ্গেই প্রশ্ন করলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কি কথা হল? অনশন কি করবেন? নাকি…
মাস্টার তারা সিং বললেন, নেই বেটা, এখানে কিছু বলব না।…
উকিলবাবু বললেন, পালাম এয়ারপোর্টে ফরেন করসপন্ডেন্ট আর টি, ভি, ক্যামেরাম্যানরা অপেক্ষা করছে। যা বলার তা ওখানেই বলা হবে।
ভাটিয়া হঠাৎ মেঝেতে বসেই মাস্টারজীর পা টিপতে শুরু করল। এই ইশারায় আমিও মাস্টারজীর পিঠ-ঘাড়-হাত টিপতে শুরু কবলাম। মাস্টারজী চোখ বুজে আমাদের সেবা উপভোগ করছেন। ওদিকে সিকিউরিটির লোকজন মাস্টারজীকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবার জন্য গাড়ি আনতে গেছে। হাতে সময় অত্যন্ত কম। মাঝে মাঝে মাস্টারজী বলছেন, এদিকটা-ওদিকটা টিপে দাও।