আজ ভাবলে অবাক লাগে যে অজয় মুখার্জীর বিদ্রোহের বহু আগেই লালবাহাদুর শাস্ত্রী বুঝেছিলেন যে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মধ্যে এমন দুর্নীতি ঢুকেছে যে তার প্রতিকার না করলে কংগ্রেসকে বাঁচানো যাবে না। তাই তো তিনি ললিত সেনের মারফত অজয় মুখার্জীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও বিয়াল্লিশের আন্দোলনের অনন্য যোদ্ধা সতীশ সামন্ত এম. পি. কে খবর দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস নেতাদের বিরুদ্ধে বলবন্তরাও মেটার রিপোর্ট বহু কাল ধামাচাপা পড়ে আছে। প্রাদেশিক নেতাদের বিরুদ্ধে আরো অনেক অভিযোগ আছে। আপনারা সে সব রিপোর্ট ও খবরের উল্লেখ করে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির কাছে স্মারকলিপি পেশ করুন। দু-চারজন ও তাদের কিছু মোসাহেবদের স্বার্থরক্ষার জন্য হাজার হাজার নিষ্ঠাবান কংগ্রেসী কংগ্রেস থেকে দূরে চলে যাবেন, তা হতেই পারে না। অজয়বাবুর এক প্রতিনিধিকে শাস্ত্রীজি নিজেও বলে ছিলেন, আনফরচুনেটুলি পণ্ডিতজী টলারেটেড দ্য ম্যানেজিং এজেন্টস অব পি. সি. সিস এ্যাজ হি ওয়াজ টু গ্রেট টু বী এ্যাফেকটেড বাই দেম–কিন্তু আমার কাছে কয়েকজন মুষ্টিমেয় নেতার গদীরক্ষার চাইতে লক্ষ লক্ষ কংগ্রেস কর্মীর স্বার্থরক্ষাই বড় কাজ।
নেপথ্যে যখন কাজকর্ম শুরু হল তার পর পরই ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব শুরু হল এবং শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রীজি মারা গেলেন। সেদিনের এই নেপথ্য কাহিনীর খবর যারা রাখেন তারা নিঃসন্দেহে স্বীকার করবেন শাস্ত্রীজি বেঁচে থাকলে কংগ্রেসের ও ভারতবর্ষের ইতিহাস অন্য রকম হত। কংগ্রেসের এই প্রাদেশিক সুবেদারদের খতম করার জন্যই শ্ৰীমতী গান্ধী নতুন কংগ্রেস গড়ে তোলেন। কংগ্রেসকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য শ্রীমতী গান্ধীর বিরুদ্ধে অনেকের অনেক অভিযোগ। তাঁর কর্মধারার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হয়েও এ কথা মুক্ত কণ্ঠে বলা যায় যে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সুবেদারদের কৃপায় কংগ্রেস এমন এক জায়গায় পৌঁছেছিল যে সার্জিক্যাল অপারেশন না করে শ্রীমতী গান্ধীর উপায় ছিল না।
মিডমিডে পিদিম আর মিড়মিড়ে বউয়ের মত আদর্শহীন, ব্যক্তিত্বহীন মানুষ আমি কোন কালেই পছন্দ করি না। হৃদয় ঐশ্বর্য সবার থাকে না, থাকতে পারে না, কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্য কেন থাকবে না? যে দুহাত বাড়িয়ে মানুষকে বুকে টেনে নিতে পারে না, যে হাসতে পারে না, খেলতে পারে না, বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারে না, দুচোখ ভরে আকাশ দেখতে পারে না, তাদের আমি কোন কালেই ভালবাসতে পারি না। শ্রদ্ধা করা তো দূরের কথা।
অল্প বয়সে খবরের কাগজের রিপোর্টার হই। তখন প্রত্যেকটি রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকেই কম-বেশি অসাধারণ মনে করতাম। অনভিজ্ঞ বলে শ্রদ্ধাও করতাম বহু জনকে। আস্তে আস্তে আমি উপলব্ধি করলাম, সব নেতাই বুদ্ধিমান না এবং নেতাদের মধ্যে বিদ্যা, বুদ্ধি, হৃদয় ঐশ্বর্য প্রায় দুর্লভ। ছলে-বলে-কলে-কৌশলেই নেতৃত্বের আসন দখল করতে হয়।
বোধ হয় এটাই নিয়ম, কিন্তু ব্যতিক্রম হয় বৈকি। যেমন কৃষ্ণমেনন।
ছোটবেলায় বা কৈশোরে খবরের কাগজের পাতায় কোন দিন কৃষ্ণমেননের নাম দেখিনি। দেশ স্বাধীন হবার পর ব্রিটেনে প্রথম ভারতীয় হাই কমিশনার রূপে কৃষ্ণমেননের নাম কাগজের পাতায় ছাপা হয় এবং কয়েক বছরের মধ্যেই জীপ স্ক্যাণ্ডাল-এর সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ে।
তখন মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত ছিল। নোট বই পেন্সিল নিয়ে হাজরা পার্ক, ওয়েলিংটন স্কোয়ার বা রাইটার্স–লালবাজার গিয়েই মনে করতাম সূর্যের চাইতে প্রদীপের আলো বেশি। তাই কৃষ্ণমেননের বিরুদ্ধে হঠাৎ এতগুলি মানুষ কেন সোচ্চার হয়ে উঠল বুঝতে পারিনি। অল্প বুদ্ধি ভয়ঙ্করী বলে মনে মনে ভেবে নিলাম, পশ্চিমবাংলার একদল অসৎ কংগ্রেসীর মত কৃষ্ণমেননও চোর, অসৎ।
পরে জেনেছি, বুঝেছি, যারা চোর চোর বলে চিৎকার করেছিল, তারা অনেকেই অসৎ, কৃষ্ণমেনন না। আজ মনে পড়ছে ১৯৬২ সালের সেই সর্বনাশা দিনের কথা। চীনের হাতে ভারত নিদারুণ ভাবে অপদস্থ। কংগ্রেসের সমস্ত দক্ষিণপন্থী নেতারা কৃষ্ণমেননকে চিরদিনের মত শেষ করে দেবার নেশায় মশগুল। দেশের মানুষও ক্ষেপে উঠেছে। নেহরু নিরুপায় হয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে কৃষ্ণমেননের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করলেন। সমালোচকদের খুশি করার জন্য কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইস্তাহার বেরুল। ভারতবর্ষের সেই মহাদুর্দিনে দক্ষিণপন্থী নেতারা মেতে উঠলেন বিজয়োৎসবে।
মন খুবই খারাপ। সারাদিন অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। ছোটাছুটিও করেছি অনেকবার পার্লামেন্ট হাউস আর সাউথ ব্লকের মধ্যে। খবরটবর পাঠিয়ে দেবার পর বাড়ি ফেরার পথে গেলাম কৃষ্ণমেননের ওখানে।
সামনের অফিস ঘরে এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রাইভেট সেক্রেটারি মহাবীর কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে ব্যস্ত। আমি ওকে বললাম, খবর দাও, আমি এসেছি।
কৃষ্ণমেননের মানসিক অবস্থা নিশ্চয়ই স্বাভাবিক ছিল না। তাই মহাবীর টেলিফোনের বাজার বাজিয়ে তাঁকে আমার আসার কথা বলতে সাহস করল না। বলল, আজ আমাকে খবর দিতে বলবেন না। আপনি চলে যান।
জিজ্ঞেস করলাম, ঘরে আর কেউ আছে?
না, কেউ নেই। মহাবীর একটু হেসে বলল, আজ আর কে আসবে?
ভিতরের বারান্দায় মেননের কুক-কাম-ভ্যালেট-কাম-পার্সোন্যাল সেক্রেটারি-কাম পার্সোন্যাল ড্রাইভার রমজানকে বললাম, সাহেবকে বল, আমি এসেছি।