মনে পড়ছে ওয়েস্টার্ণ কোর্টের এক দিনের ঘটনা। হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী হাজির হতেই সবাই অবাক। রিসেপসনিস্ট ছুটে এলেন। শাস্ত্রীজি তার কাছে ললিত সেনের ঘরের নম্বর জেনে নিয়ে নিজেই সে ঘরের দরজায় হাজির। দরজায় তালা দেখেই ফিরে গেলেন। কয়েক ঘণ্টা পরে আবার শাস্ত্রীজি এলেন ওয়েস্টার্ণ কোর্টে। না, এবারও ললিত সেনকে পেলেন না। চলে গেলেন। একটু পরেই ললিত সেন ফিরে এসে শুনলেন প্রধানমন্ত্রী দুবার এসে ঘুরে গেছেন। উনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি। ওকে দেখেই শাস্ত্রীজি বললেন, একটা অনুরোধ করার জন্য তোমার ওখানে গিয়েছিলাম।
ললিত সেন বললেন, আপনি আমাকে ডেকে পাঠালেন না কেন?
না ললিত, তা হয় না। আমার দরকারে তোমাকে কষ্ট দেব কেন?
তাতে কি হল? বলুন, কি দরকার।
আমার কাজে তোমাকে সাহায্য করতে হবে।
নিশ্চয়ই করব।
তোমায় আমার পার্লামেন্টারী সেক্রেটারি হতে হবে।
বঙ্গেশ্বর লক্ষ্মণ সেনের বংশধর ললিত সেন একটু হেসে বললেন, আপনি যদি আমাকে এ কাজের উপযুক্ত মনে করেন, তাহলে আমার কি আপত্তি? তবে এ কথা বলার জন্য আপনি কেন কষ্ট করে দুবার ওয়েস্টার্ণ কোর্ট গিয়েছিলেন?
শাস্ত্রীজি বললেন, ললিত, আমিও ভোটে জিতে এম. পি. হয়েছি, তুমিও তাই। আজ তোমরা আমাকে প্রধানমন্ত্রী করেছ বলে কি তোমাদের আমি উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করতে পারি?
জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি এই ছিল শাস্ত্রীজির মনোভাব। এম. পি-দের প্রতি এমন শ্রদ্ধার মনোভাব সত্যি দুর্লভ। শ্ৰীমতী গান্ধী মন্ত্রীসভার সদস্যদের চিঠি লেখেন না, নিজে অনুরোধও জানান না এভাবে। সাধারণত ওর প্রাইভেট সেক্রেটারি ধরনের কোন কর্মচারী সংশ্লিষ্টদের টেলিফোনে জানিয়ে দেন, আপনি রাষ্ট্রপতি ভবনে আসুন, শপথ নিতে হবে। রাষ্ট্রপতি ডক্টর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের অনুরোধেই শ্ৰীমতী গান্ধী কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের তদানীন্তন উপাচার্য ডক্টর ত্রিগুণা সেনকে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী করেন, কিন্তু ভক্টর সেন এ খবর পান প্রাইম মিনিস্টারের সেক্রেটারি যশপাল কাপুরের কাছ থেকে। যশপাল কাপুর ওকে বেনারসে টেলিফোন করে বলেন, ডক্টর সেন, আপনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। দিল্লী চলে আসুন। শপথ নিতে হবে। টেলিফোন পেয়ে ত্রিগুণাবাবু অবাক। ভাবেন, লোকটা বলে কি? একবার ভাবলেন, কেউ ঠাট্টা করছে না তো? এ সব কথা ভাবতে ভাবতেই কাশীর লোকজন মালা নিয়ে হাজির। কী ব্যাপার? রেডিওতে বলল, আপনি সেণ্টল মিনিস্টার হয়েছেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বারানসীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এসে সেলাম করে বাড়ির দরজায় সশস্ত্র প্রহরী মোতায়েন করলেন। ত্রিগুণাবাবু স্বীকৃতি না জানালেও মালা, অভিনন্দন আর রাইফেলধারীদের সেলামের ঠেলায় পরদিনই দিল্লী ছুটতে বাধ্য হলেন। শ্রীমতী গান্ধী এই ভাবেই মন্ত্রী নিয়োগ করেন।
ললিত সেন পার্লামেন্টারী সেক্রেটারি হলেও শাস্ত্রীজি ওকে যেমন বিশ্বাস করতেন তেমনি ভালবাসতেন। প্রধানমন্ত্রীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন রাজনৈতিক কাজের দায়িত্ব বহন করতে হত ললিত সেনকে। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা না লিখে পারছি না।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বহন করা সত্বেও শাস্ত্রীজি কংগ্রেস সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সারা দেশের কংগ্রেস কর্মীদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় যোগাযোগ ছিল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের মৃত্যুর পর শাস্ত্রীই একমাত্র শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন যার সঙ্গে কংগ্রেস কর্মীদের নিয়মিত ও প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। তাই দেশের নানা প্রান্তের কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানের ভিতরের খবর ও কর্মীদের মনোভাব শাস্ত্রীজি খুব ভাল করেই জানতেন। তাইতো তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বিভিন্ন প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিগুলিকে কয়েকজন সুবেদারের নিজস্ব জমিদারীতে পরিণত করা হয়েছে এবং এই সব নেতাদের জমিদারী মনোবৃত্তি ও পরিচালনা পদ্ধতির জন্যই কংগ্রেস দিনে দিনে দুর্বল হয়ে উঠেছে।
নেহরু নিজেও এই সব প্রাদেশিক কংগ্রেসী সুবেদারদের দেখতে পারতেন না এবং নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায় যে এই সব নেতাদের নিজের কাছে ঘেষতে দিতেন না। বেশ কয়েক বছর প্রতি দিন প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান তিনমূর্তি ভবনে গেছি কিন্তু মনে পড়ে না কামরাজ, বিজু পটনায়ক, বা অন্য দু-একজন ছাড়া অন্য কোন প্রাদেশিক নেতাকে নেহরুর সঙ্গে ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চ বা ডিনার খেতে দেখেছি। নেহরুর বাড়িতে নানা ধরনের উৎসব হত কিন্তু সেসব উৎসবে পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ, লালবাহাদুর শাস্ত্রী ও কৃষ্ণমেনন ছাড়া অন্য কোন কংগ্রেস নেতাকে আমন্ত্রিত হতে দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। কংগ্রেসের এই সব প্রাদেশিক সুবেদারদের নেহরু ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ না করলেও প্রাদেশিক কংগ্রেসের ওপর তাদের প্রভুত্ব ঠিকই বজায় ছিল। কারণ নেহরু এই সব নেতাদের থেকে এত ওপরের, এত জনপ্রিয় ও সর্বোপরি এত ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন যে তিনি ওদের মত সুবেদারদের উপেক্ষা করেও স্বচ্ছন্দে প্রধানমন্ত্রী থাকতে পেরেছেন। শাস্ত্রীজি প্রধানমন্ত্রী হবার অনেক আগেই বুঝেছিলেন, এই সব প্রাদেশিক সুবেদারদের হাতে না পারলে আপামর সাধারণকে কংগ্রেসের প্রতি আকৃষ্ট করা যাবে না। তাছাড়া এই সব সুবেদাররা নিজেদের গদী ঠিক রাখার জন্য বহু নিষ্ঠাবান কংগ্রেসীকে মণ্ডল বা জেলা কংগ্রেস কমিটির সভ্য হবার সুযোগ দেন না এবং নতুন সদস্য করার ব্যাপারে এই সব সুবেদাররা বহু রকমের দুর্নীতির প্রশ্রয় নেন। সর্বোপরি শাস্ত্রীজি জানতেন এই সব প্রাদেশিক নেতারা কংগ্রেসের নামে অর্থ সংগ্রহ করে নিজের ও নিজের গোষ্ঠীর জন্য ব্যয় করেন। আর? আর জানতেন এই সব নেতারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিল্পপতি ও ব্যবসাদারদের অর্থে বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন। এদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য শাস্ত্রীজি উপযুক্ত সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হবার পর শাস্ত্রীজি মনে করলেন, সে সুযোগ ও সময় সমাগত।