বিরাট জায়গা নিয়ে কাটমাণ্ডুর ভারতীয় দূতাবাস। একদিকে চান্সেরী ও কিছু কোয়াটার্স। অন্য দিকে রাষ্ট্রদূতের নিবাস। পরের দিন যথা সময় আমি দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রদূতের নিবাসে পৌঁছলাম রাস্তা আর বিরাট লন পার হয়ে রাষ্ট্রদূতের ঘরের পাশ দিয়ে বারান্দার এক কোণায় পৌঁছতেই সশস্ত্র প্রহরী আমাকে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে ঘুরিয়ে বারান্দার অন্য কোথায় নিয়ে যেতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। সশস্ত্র প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাম, বারান্দার এ পাশ থেকে ও পাশে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে আনলে কেন? সে জানাল, ডিপ্লোম্যাট ছাড়া অন্য কারুর এ্যাম্বাসেডর সাহেবের জানালার সামনে দিয়ে যাবার হুকুম নেই।
শুনে শুধু অবাক হলাম না, রাগে অপমানে সারা শরীর জ্বলে উঠল। এ্যাম্বাসেডরের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে জিজ্ঞেস করলাম, এই কি আপনাদের নিয়ম।
সে সবিনয়ে উত্তর দিল, হ্যাঁ স্যার।
প্রাইভেট সেক্রেটারির কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ নিয়ে লিখলাম, ডিয়ার মিঃ এ্যাম্বাসেডর, আপনি ঘরে আছেন বলে আপনার জানালার সামনে দিয়ে হাঁটার অধিকার আমার নেই। ছোট্ট বারান্দার এ কোণ থেকে ও কোণ আসার জন্য আমাকে আপনার বাড়ির পিছন দিক দিয়ে ঘুরে আসতে হল। এই ধরনের অপমান সহ্য করার অভ্যাস আমার নেই। তাই আপনার সঙ্গে আমার লাঞ্চ খাওয়া সম্ভব নয়। আপনার অসাধারণ সৌজন্যের কথা আমি মিঃ কৃষ্ণ মেননকে বলব।
আমার চিরকুট পড়ে প্রাইভেট সেক্রেটারির চোখ ছানাবড়া। সে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, স্যার, আপনি চলে যাচ্ছেন?
আসি হেসে বললাম, হ্যাঁ।
লাঞ্চ খাবেন না?
আমি আবার হেসে বললাম, এত খাবার পরও কি লাঞ্চ খাবার দরকার আছে? আর বললাম, আমি আপনার এ্যাম্বাসেডরের জানালার সামনে দিয়েই চলে যাচ্ছি। যদি উনি অপমান বোধ করেন তাহলে যেন তার প্রতিবাদ করেন।
পরে হরেশ্বর দয়াল আমাকে টেলিফোন করে বললেন, আই এ্যাম সরি, বাট এটা অনেক দিনের নিয়ম।
আমি হেসে বললাম, নিয়মটা আপনার ভাল লাগে বলেই তো আপনি বদলাননি। আর বললাম, ভারতীয় সাংবাদিক হয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কাছে আমি যে অপমান সহ্য করেছি তাতেই বুঝতে পারছি নেপালীদের কপালে কি জোটে।
কথাটা নিছক রাগ করে বলিনি। বহুকাল ভারতীয় দূতাবাসের সমগ্র এলাকার মধ্যে কোন নেপালী ছাতি মাথায় দিতে পারতেন না। কারণ? দূতাবাসের এলাকায় নেপালীরা ছাতি মাথায় দিলে গণতান্ত্রিক ভারত সরকারের হিজ একসেলেন্সী এ্যাম্বাসেডরের অপমান করা হয়। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে শুধু হায়দ্রাবাদে এই নিয়ম ছিল। নিজাম রাস্তা দিয়ে যাবার সময় কেউ ছাতি মাথায় দিতে পারতেন না। কেন? ছাতি মাথায় দিলে নিজামকে অপমান করা হবে।
সব কিছু বলার পর আমি জুগরানকে জিজ্ঞেস করলাম, এই সব শোনার পরও কি আপনি আমাকে মিঃ দয়ালের কাছে নিয়ে যেতে চান?
জুগরান সে কথার জবাব না দিয়ে হেসে বলল, নাউ উই মাস্ট হ্যাভ ড্রিঙ্কস!
আমি হেসে বললাম, দ্যাটস্ বেটার এ্যাণ্ড মোর অনারেবল।
শাস্ত্রীজির কাটমাণ্ডু পৌঁছতে একদিন দেরী হল। হঠাৎ রাজেন্দ্র প্রসাদ মারা যাওয়ায় শাস্ত্রীজি তাঁর শেষকৃত্যে যোগদান করে পরের দিন কাটমাণ্ডু পৌঁছলেন। প্রটোকলের তোয়াক্কা না করে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ডাঃ তুলসী গিরি বিমানবন্দরে হাজির হয়ে সবাইকে বিস্মিত করলেন। নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপা তো ছিলেনই।
অনেক দিন পর ডাঃ গিরির সঙ্গে দেখা। মনে মনে ভয় ছিল হয়তো প্রধানমন্ত্রী হবার পর কিছু পরিবর্তন হয়েছে এবং আমাকে চিনতে পারবেন না। তাই শাস্ত্রীজির বিমান পৌঁছবার আগে ওকে দেখেও ওর কাছে যেতে দ্বিধা করছিলাম কিন্তু উনি নিজেই এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি কবে এলে?
পরশু।
আমাকে ফোন করনি কেন?
আমি হেসে বললাম, হাজার হোক আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনাকে বিরক্ত করা কি ঠিক?
ডাঃ গিরি হেসে বললেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছি বলে তোমাকে ভুলে যাব? যাই হোক, তুমি আমার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যেও না।
না না, নিশ্চয়ই দেখা করব।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপার সঙ্গে উনিই আমার আলাপ করিয়ে দিলেন। থাপাও সাদরে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন ওর বাড়ি।
পরিচয় হল আরো অনেকের সঙ্গে। কথাবার্তাও হল। কথা বললাম না শুধু ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হরেশ্বর দয়ালের সঙ্গে। প্রেস এ্যাটাশে জুগরানের সঙ্গে দিল্লী থেকেই পরিচয় ছিল। এই দুদিনের আড্ডা-হাসিঠাট্টা আর বিশুদ্ধ স্কচের কৃপায় সে পরিচয় নিবিড় বন্ধুদ্ধে পরিণত হয়। তাই সে আমার কানে কানে ফিস ফিস করে বলে, তুমি শালা আমার এ্যাম্বাসেডরকে আর কত অপমান করবে?
আমিও ফিস ফিস করে জবাব দিলাম, তোমার প্রাণের প্রিয় এ্যাম্বাসেডরকে টাইট দেবার লোক আর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই এসে পৌঁছচ্ছেন।
স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে এয়ারপোর্টে দেখে শাস্ত্রীজি মুগ্ধ হলেন। সকৃতজ্ঞ চিত্তে বললেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী। আপনার কত কাজ। আমার মত একজনকে অভ্যর্থনা করার জন্য আপনি কেন এত কষ্ট করলেন?
ডাঃ গিরি বললেন, শাস্ত্রীজি, আপনাকে শুধু আপনার দেশের লোকই শ্রদ্ধা করে না, আমরাও করি!
.
এয়ারপোর্ট থেকে শীতল নিবাস। রাজকীয় অতিথিশালা। শাস্ত্রীজি ও শ্ৰীমতী ললিতা শাস্ত্রী ঘরদোর-বিছানা দেখে অবাক। শাস্ত্রীজি হাসতে হাসতে বিছানা দেখিয়ে নেপাল সরকারের চীফ অব প্রটোকল ঠাকুরসাহেবকে বললেন, এত মোটা গদীর ওপরে শোওয়া অভ্যাস নেই। আপনি বরং আমাদের জন্য সাধারণ বিছানার ব্যবস্থা করুন। ঠাকুরসাহেব প্রথমে আপত্তি করলেও পরমুহূর্তে বুঝলেন, এই সহজ সরল মানুষটি রাজনীতির স্বর্ণ শিখর প্রাঙ্গণের অন্যতম নায়ক হয়েও সত্যি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন এবং তিনি সত্যি সত্যি মোটা গদী সরিয়ে দেবার হুকুম দিলেন। পরে ঠাকুরসাহেব বলেছিলেন, এই শীতল নিবাসে আরো অনেক ভারতীয় নেতাই থেকেছেন। কিন্তু এই ধরনের অনুরোধ আর কেউ করেননি।