ইতিমধ্যে শুরু হল ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ। সংঘর্ষ। নেপালের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল রাতারাতি। ভারত-নেপাল সম্পর্কের অবনতি রোধই নয়, অবিলম্বে উন্নতির প্রয়োজন দেখা দিল। কিন্তু কে বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে? যে আই-সি-এস আই-এফ-এস কূলচূড়ামণিরা ভারতবর্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোকিত করে রাখেন তাদের মধ্যে এমন কাউকে পাওয়া গেল না যিনি এ কাজ করতে পারেন। সর্দার স্বরণ সিং বহুবার পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিলেও তাঁকেও ঠিক উপযুক্ত মনে হল না। তবে কি নেহরু স্বয়ং? যাঁর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জল এত ঘোলা হয়েছে তার যাওয়া ঠিক নয়। তাছাড়া নেহরু নিজে এগিয়ে গেলে ভারত সরকারের মর্যাদাও অক্ষুণ্ণ থাকবে না। তবে কি কৃষ্ণ মেনন? না, দেশরক্ষামন্ত্রী নেপাল গেলে নানা দেশে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে এবং নেপালও অস্বস্তিবোধ করবে। তবে কে?
অনেক ভেবেচিন্তে নেহরু শাস্ত্রীজিকে বললেন, লালবাহাদুর, তুমি নেপাল যাও।
শাস্ত্রীজি অবাক হয়ে বললেন, আমি!
হ্যাঁ, তুমি।
শাস্ত্রীজি হেসে বললেন, আমি তো কোন দিন দেশের বাইরে যাইনি। তাছাড়া ফরেন এ্যাফেয়ার্সের ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞও না।
পণ্ডিতজী সরাসরি বললেন, তাতে কি হল? তুমি তো ক্যাবিনেটের পলিটিক্যাল এ্যাফেয়ার্স কমিটির মেম্বার। তোমার আবার কি অজানা?
কয়েকদিন পরেই সরকারীভাবে ঘোষণা করা হল, নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিশ্ববন্ধু থাপার আমন্ত্রণে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী সন্ত্ৰীক নেপাল সফর করবেন।
নিত্যকার মত পরের দিন সকালে অফিস যাবার পথে শাস্ত্রীজির বাড়ি যেতেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নেপাল গিয়েছ?
হ্যাঁ।
ওখানকার লোকজনের সঙ্গে পরিচয় আছে?
আমি হেসে বললাম, নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডাঃ তুলসী গিরির সঙ্গে আমার খুবই মধুর সম্পর্ক।
তাই নাকি?
হ্যা।
কিন্তু কি ভাবে?
অনেক কাল ধরেই পরিচয়। তাছাড়া বেলগ্রেডে নন-এ্যালাইণ্ড নেশনস্ কনফারেন্সের সময় আমি আর ডাঃ গিরি খুবই ঘনিষ্ঠ হই।
শুনে খুশি হলেন শাস্ত্রীজি। একটু হেসে বললেন, তাহলে আমি যখন নেপাল যাব, তুমি কি যেতে পারবে?
আমি বললাম, সম্পাদকের সঙ্গে আজই টেলিফোনে কথা বলব।
রাত্রে সম্পাদকের সঙ্গে কথা বললাম। উনি মত দিলেন। দু-একদিনের মধ্যেই বিমানের টিকিট ও টাকা পাঠিয়ে দিলেন। শাস্ত্রীজি রওনা হবার একদিন আগেই আমি দিল্লী থেকে কাটমাণ্ডু রওনা হলাম।
কাটমাণ্ডু বিমানবন্দরে পৌঁছে দু-একজনের সঙ্গে কথা বলছি। হঠাৎ দেখি প্রধানমন্ত্রী ডাঃ গিরির স্ত্রী এয়ারপোর্টে ঘুরছেন। সঙ্গে বেশ কয়েকজন পুলিশ অফিসার। মিসেস গিরির সঙ্গে কথা বলার জন্য এগিয়ে যেতেই একজন পুলিশ অফিসার আমাকে বাধা দিলেন। অনুরোধ করলাম, ওঁকে আমার কথা বলতে, কিন্তু অফিসারটি এমন বিরক্তি প্রকাশ করলেন যে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। সন্দেহ হল, বোধ হয় ভারতীয় সাংবাদিক বলেই আমাকে এমন করে উপেক্ষা করা হল। বুঝলাম, ভারত-নেপাল সম্পর্ক কোথায় এসে পৌঁছেছে।
দুপুরে আমাদের এম্বাসীতে গেলাম। দু-একজন পূর্বপরিচিত অফিসারের সঙ্গে দেখা করার পর গেলাম প্রেস এ্যাটাশে মিঃ জুগরানের কাছে। কাজ-পাগল প্রাণবন্ত মানুষ। প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, মিশতে পারেন মানুষের সঙ্গে। অনেক হাসিঠাট্টা, গল্পগুজব হল। কফি খেলাম পর পর। সিগারেট পোড়ালাম অনেকগুলো। তারপর হঠাৎ জুগরান চেয়ার ছেড়ে উঠেই বলল, চলুন, আপনার সঙ্গে এ্যাম্বাসেডরের পরিচয় করিয়ে দিই।
আমি হেসে বললাম, ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।
কবে পরিচয় হল? আজই।
না, এর আগেই পরিচয় হয়েছে।
জুগরান এগিয়ে এসে বলল, তা থাক। চলুন, দেখা করে আসবেন।
আমি বললাম, না, ওর সঙ্গে আমি দেখা করব না।
কেন?
আমি হেসে বললাম, শুনতে চাও?
জুগরান অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই শুনতে চাই।
.
কুইন এলিজাবেথ যখন ভারত-পাকিস্তান-নেপাল সফরে আসেন, তখন সাংবাদিক হিসেবে আমিও তার সঙ্গী হলাম। বহু অনুরোধ উপরোধ করা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার কুইন্স প্রেস পার্টির ভারতীয় সদস্যদের ভিসা মঞ্জুর করলেন না। নেপালে যাবার জন্যে ভিসার প্রয়োজন নেই কিন্তু রাণীর সফর কভার করার জন্য নেপাল সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা অবশ্যই চাই। পর পর কয়েকটা চিঠি লিখেও নেপাল সরকারের কাছ থেকে কোন উত্তর পেলাম না। ভারত নেপাল সম্পর্কের তৎকালীন পরিবেশের জন্যই ভারতীয় সাংবাদিকদের প্রতি নেপাল সরকার এই রকম ঔদাসীন্য দেখান। স্থির করলাম, নেপাল যাবই, তারপর যা হয় হবে। তবু সাবধানের মার নেই। কৃষ্ণ মেননকে সব কথা জানাতেই উনি নেপালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মিঃ হরেশ্বর দয়ালকে একটা ব্যক্তিগত চিঠি লিখে আমাকে যথাসম্ভব সাহায্য করতে বললেন।
কাটমাণ্ডু পৌঁছে দেখি, নেপাল সরকার আমাদের চিঠিপত্রের জবাব না দিলেও বৃটিশ সাংবাদিকদের মত আমাদের জন্যও সব ব্যবস্থা করেছেন। কুইন্স পার্টির অন্যান্যদের মত আমরাও রাজকীয় নেপাল সরকারের অতিথি হয়ে রয়্যাল হোটেলে রইলাম। রাষ্ট্রদূত হরেশ্বর দয়ালের কাছে কোন সাহায্য চাইবার প্রয়োজন হল না। তবে ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। উনি পরের দিন আমাকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানালেন।