দিন দুই পরে ঐ সেন্ট্রাল হলের আড্ডাখানাতেই শুনলাম, সেদিন যে প্লেনে সাহেব ও মাড়োয়ারী কর্তাদের কলকাতা থেকে গৌহাটি যাবার কথা ছিল, সে প্লেনে হঠাৎ যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। ওরা বহুক্ষণ দমদম এয়ারপোর্টে বসে থাকার পর যখন দেখলেন গৌহাটির কোর্ট-কাছারি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক ইত্যাদি বন্ধ হবার সময় হয়ে আসছে এবং সেদিন ঐ লেনদেন পাকাপাকি করায় সময় নেই, তখন ওরা ফিরে গেলেন। ওরা দমদম ছেড়ে চলে যাবার পর পরই প্লেনের যান্ত্রিক গোলযোগও ঠিক হয়ে গেল। আর ওরা যখন দমদমে বসে আছেন তখন কেন্দ্রীয় সরকারের হুকুমে একদল সরকারী অফিসার ঐ চা বাগানের কিছু আইন বহির্ভূত কাজকর্মের জন্য ওর পরিচালনার দায়িত্ব সামরিক ভাবে নিয়ে নিলেন। কাকপক্ষী জানল না কিন্তু আসল উদ্দেশ্য সফল হল। এই হল লালবাহাদুর শাস্ত্রী!
কেন কাশ্মীরে কী করলেন? হজরতবল মসজিদ থেকে হজরতের পবিত্র কেশ চুরি হওয়ায় চারদিকে দারুণ হৈ-চৈ শুরু হল। গোয়েন্দাদের তৎপরতায় কেশ উদ্ধার হল কিন্তু কাশ্মীরের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতারাই বললেন, না, ও কেশ, সে কেশ নয়। কাশ্মীরে তখন এমন উত্তপ্ত আবহাওয়া যে, যে কোন মুহূর্তে অঘটন ঘটতে পারে। বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে লালবাহাদুর চলে গেলেন কাশ্মীর। একই সময়ে সব ধর্মীয় নেতাদের ডাকলেন সরকারী অতিথিশালায় কিন্তু প্রত্যেককে আলাদা আলাদা গাড়িতে আনা হল এবং আলাদা আলাদা ঘরে বসানো হল। অর্থাৎ সবাই ভাবলেন, শান্ধীজি শুধু তাঁর সঙ্গেই আলোচনা করতে চান এবং এ খবর আর কেউ জানেন না। এবার শাস্ত্রীজি নিজে প্রথম ঘরে গিয়ে একজন নেতার সঙ্গে আলাদা ভাবে আলোচনা করলেন এবং তিনি স্বীকার করলেন, এটাই পয়গম্বরের কেশ, কিন্তু অন্যেরা স্বীকার করছে না। শাস্ত্রীজি ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে দ্বিতীয় ঘরে এসে দ্বিতীয় নেতার সঙ্গে কথা বললেন। উনি বললেন, আমি তো জানি এটা পয়গম্বরের কেশ কিন্তু অন্যেরা স্বীকার করছে না। এভাবে শাস্ত্রীজি প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা ভাবে কথা বলে একই কথা শুনলেন। এবার সবাইকে বাইরে ডাকা হল। নেতারা একে অন্যকে দেখে অবাক! মাইক্রোফোন প্রস্তুত। দল পাকিয়ে গণ্ডগোল করার কোন অবকাশ নেই। শাস্ত্রীজির আমন্ত্রণে একে একে প্রত্যেক নেতা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, হ্যাঁ, এই সেই পয়গম্বরের পবিত্র কেশ। ধর্মীয় নেতাদের এই ভাষণ রেকর্ড করে সঙ্গে সঙ্গে প্রচারিত হল কাশ্মীর রেডিওতে।
যে সমস্যা নিয়ে সারা কাশ্মীর উপত্যকায় প্রায় আগুন জ্বলে উঠেছিল, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে সমস্যার সমাধান করে লালবাহাদুর ফিরে এলেন দিল্লী।
. গ্রামের ছেলে লালবাহাদুর। অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ বা ইটন-হ্যারোতে নয়, গ্রামের পাঠশালা আর কাশী বিদ্যাপীঠে লেখাপড়া করেছেন। পরতেন সাধারণ ধুতি পাঞ্জাবি, কিন্তু তাই বলে সৌজন্যবোধের অভাব ছিল না শাস্ত্রীজির।
লণ্ডনে কমনওয়েলথ প্রাইম মিনিস্টার্স কনফারেন্স কভারে গেছি। মার্লবোরা হাউসে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর প্রেস রিসেপসন। এই রিসেপসনেই দেশনায়কদের সঙ্গে সাংবাদিকদের মেলামেশা গল্পগুজব। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রত্যেক সাংবাদিককে ড্রিঙ্ক তুলে দেন প্রবেশ পথের মুখে। আমি ঢুকতে গিয়েই দেখি, বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছে দাঁড়িয়ে শাস্ত্রীজি ঘানার নক্রুমার সঙ্গে কথা বলছেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে ড্রিঙ্ক কিন্তু সামনে শাস্ত্রীজিকে দেখে আমি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছি। শাস্ত্রীজি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে চোখের ইসারায় আমাকে ইঙ্গিত করলেন, নিয়ে নাও। আমি হাসতে হাসতে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে ড্রিঙ্ক গ্রহণ করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আয়ুবের কাছে এগিয়ে গেলাম।
শাস্ত্রীজির কথা লিখতে বসে কত কথা মনে পড়ছে। ভাবপ্রবণ জহরলাল কখনও কখনও এমন এক একটি মন্তব্য করতেন যে তার ফলে অনেক সময় বহু সমস্যা জটিলতর হয়ে উঠত। যেমন ভারত নেপাল সম্পর্ক।
ভারত নেপালের সম্পর্ক নানা কারণে খুবই নিবিড়। তাইতো রাণাদের আধিপত্য শেষ করার জন্য ভারত নেপালের পাশে এসে দাঁড়ায়। মুখ্যত জয়প্রকাশ-লোহিয়ার মত কিছু সোসালিস্ট নেতার উদ্যোগে ভারতবর্ষের মানুষ নেপালবাসীদের সাহায্যে এগিয়ে এলেও ভারত সরকারও পিছিয়ে থাকেনি। নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নেহরুর অবদান অনস্বীকার্য। নেপালের চরম দুর্দিনে রাজা ত্রিভুবনকে সাদরে আশ্রয় দিয়েছিলেন ভারত সরকার। তারপর রাজা ত্রিভুবন নেপালে ফিরে গেলে কৈরালার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ভারত নেপালের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। নেপালের রাজা ও নেপালের মানুষ এ সব কথা আজও ভোলেনি। যাই হোক, পরবর্তী কালে রাজা মহেন্দ্র রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে এমন সরকার গঠন করেন, যা গণতান্ত্রিক ভারতকে দুঃখ দেয়। পত্র পত্রিকায় ও নানা রাজনৈতিক দলের সভা-সমিতিতে রাজা মহেন্দ্রর সমালোচনাও করা হয়। নেপাল ভারতবর্ষের ব্যাপারে এত ওয়াকিবহাল যে এ সব সমালোচনায় খুশি না হলেও মেনে নিয়েছে কিন্তু যেদিন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নেহরু রাজা মহেন্দ্রর এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন, সেদিন নেপাল সরকার তা নীরবে মেনে নিতে পারেনি। স্বাধীন সার্বভৌম নেপাল সরকার বিনা দ্বিধায় জানিয়ে দিল, আমাদের দেশে কি ধরনের সরকার হবে, তা আমাদের বিচার্য, ভারত সরকারের নয়। নেহরুর ঐ একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারত-নেপাল সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটতে শুরু করল।