- বইয়ের নামঃ জার্নালিস্টের জার্নাল
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০১. আমি কোন মহাপুরুষ নই
আমি কোন মহাপুরুষ নই যে আত্মজীবনী লিখব; যশস্বী বা কৃতি পুরুষদের মত স্মৃতিকথা লেখার অধিকারও আমার নেই। তবু সব মানুষের মতই জীবনের পথ চলতে চলতে কিছু দেখেছি, কিছু শুনেছি। কিছু কিছু উপলব্ধিও করেছি। অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মেছি। ছোটবেলায় শিয়ালদহ স্টেশনের আশেপাশের পেট মোটা কনস্টেবল দেখেই ঘাবড়ে যেতাম। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিতে না দিতেই খবরের কাগজের রিপোর্টার হলাম। রাইটার্স বিল্ডিংস-লালবাজার যাতায়াত তখন নিত্যকর্ম হল। মাঝে মাঝে রাজভবনে বা দমদম এয়ারপোর্টে বা ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউণ্ডে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর দর্শনও জুটে যেত। তারপর হঠাৎ অনেক কিছু ঘটে গেল আমার জীবনে। যা কোন দিনই হবার কথা নয়, যা কোন দিন স্বপ্নেও ভাবিনি, তাই ঘটে গেল। একের পর এক। মাসের পর মাস বছরের পর বছর।
মাঝে মাঝে সেই সব ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে অনেক স্মৃতি, অনেক কাহিনী। কোন ধারাবাহিক ইতিহাস নয়, সেই সব টুকরো টুকরো স্মৃতি আর কাহিনী নিয়েই আমার জার্ণালিস্টের জার্ণাল।
.
আমি তখন কলকাতার এক অখ্যাত দৈনিকে পনেরো-বিশ টাকা মাইনের রিপোর্টার। তা হোক। সংবাদ সংগ্রহের ব্যাপারে আমার অদম্য উৎসাহ। নিত্যই রাইটার্সে কিছু মন্ত্রীর ঘরে হানা দিই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা কলকাতায় এলেও তাদের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করি।
সে সময় উদ্বাস্তু সমস্যা ছিল কলকাতার সংবাদপত্রগুলোর অন্যতম প্রধান খোরাক। তাই তো নেহরু মন্ত্রীসভার আইন ও সংখ্যালঘু দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ্রীচারুচন্দ্র বিশ্বাস কলকাতায় এলেই অনেক রিপোর্টারই ওঁর কাছ থেকে কিছু সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিশেষ তৎপর হয়ে উঠতেন। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু দপ্তরের একটা অফিসও ছিল কলকাতায়। তাই চারুবাবুকে প্রায়ই আসতে হত কলকাতায়।
সেবার অন্য কোন রিপোর্টার পৌঁছবার আগেই আমি চারুবাবুর কলকাতার বাড়িতে হাজির। খবরের কথা বলতেই উনি চমকে উঠলেন, না না, কিচ্ছু খবর দিতে পারব না।
সবিনয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন?
উনি বললেন, আই এ্যাম আণ্ডার ওথ। আই কান্ট ডিসক্লোজ এনিথিং।
আমি ওঁর কথা শুনে অবাক। কলকাতা হাইকোর্টের ভূতপূর্ব বিচারপতি মাননীয় সি. সি. বিশ্বাসের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করলাম, অন্যান্য মন্ত্রীরা মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিলেও তো রিপোর্টারদের খবর দেন।
জাস্টিস বিশ্বাস আবার বললেন, নো নো, আই এ্যাম আণ্ডার ওখ। আই কান্ট ডিসক্লোজ এনিথিং।
আমি বার বার ওঁকে অনুরোধ করলাম এবং প্রতিবারই উনি এক জবাব দেন, সরি, আই এ্যাম আণ্ডার ওথ। আমি কোন খবর ফাঁস করতে পারব না।
আমি খবর পাবার আশায় প্রায় জলাঞ্জলি দিয়েছি, এমন সময় হঠাৎ উনি ওঁর পার্সোন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্টকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, আমি কি কালকের ডায়েরীর নোট দিয়েছি?
পি. এ. বললেন, না স্যার।
জাষ্টিস বিশ্বাস বললেন, নোট ডাউন।
পার্সোন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট সর্টহ্যাণ্ড নোটবই-পেন্সিল নিয়েই ঘরে এসেছিলেন। উনি আমার পাশের চেয়ারে বসতেই জাষ্টিস বিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে বলতে শুরু করলেন–আমি যথারীতি ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠি এবং বেড়াতেও গিয়েছিলাম। বাংলোয় ফিরে এসেই শুনি, মাননীয় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার সর্দার প্যাটেল আমাকে অবিলম্বে দেখা করতে বলেছেন। আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সর্দার প্যাটেলের বাড়ি রওনা হলাম। …
জাস্টিস বিশ্বাস চোখ বুজে তার আগের দিনের সবকিছু ঘটনা বলছেন। পার্সোন্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট এক মনে সর্টহ্যাণ্ডে নোট নিচ্ছেন। আর আমি? শুনছি আর মনে মনে হাসছি।
..সর্দার প্যাটেল আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আজকের ক্যাবিনেটে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নতুন করে উদ্বাস্তু আগমন নিয়ে যে আলোচনা হবে, তার জন্য কোন নোট তৈরি করেছি কি? আমি মাননীয় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টারকে জানালাম, ড্রাফট তৈরি হয়েছে এবং এখনই বাড়ি গিয়ে ওটাকে ফাইন্যাল করব। ঐ ড্রাফট নোটস সম্পর্কে দু-চারটে প্রশ্ন করার পর সর্দার প্যাটেল বললেন, ঐটি ফাইন্যাল করে আমার কাছে নিয়ে আসুন।
তারপর?
জাস্টিস বিশ্বাস বললেন, সর্দার প্যাটেল আমার তৈরি নোটটি পড়েই বললেন, না, এটা ঠিক হয়নি। তারপর উনি নিজেই পি. এ-কে ডেকে একটা নতুন নোট ডিক্টেট করলেন। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে পি. এ. ঐ নোটটি টাইপ করে আনতেই সর্দার প্যাটেলের নির্দেশ মত আমি তার নীচে সই করলাম। তারপর সর্দার প্যাটেল আমাকে বললেন, আমি যে এই নোট তৈরি করেছি, তা যেন ক্যাবিনেটের কেউ না জানেন।…
আমি জাষ্টিস বিশ্বাসের কথা শুনতে শুনতে মনে মনে চঞ্চল হয়ে উঠলেও পাথরের মত চুপ করে বসে আছি।
….ক্যাবিনেট মিটিং-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আবার নতুন করে হাজার হাজার উদ্বাস্তু আসার প্রসঙ্গ উঠতেই আমি আমার নোটটি বের করলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে সর্দার প্যাটেল এটি আমার কাছ থেকে নিয়ে সবাইকে পড়ে শোনালেন। অন্য কেউ কিছু বলার আগেই মাননীয় ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার মন্তব্য করলেন, জাস্টিস বিশ্বাসের নোটটিতে বর্তমান পরিস্থিতি ও আমাদের মনোভাব বেশ পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে। সুতরাং এই নোটের ভিত্তিতেই অবিলম্বে পাকিস্তান সরকারের কাছে একটা প্রতিবাদ-পত্র পাঠানো যেতে পারে। সামান্য আলোচনার পরই ক্যাবিনেট সর্দার প্যাটেলের প্রস্তাব মেনে নিলেন।…