কবি বলিলেন, ‘কবিতাটি আমাকে দাও। আমি নিজেই পড়ি।’
আমি বলিলাম, আমার হাতের লেখা আপনি পড়তে পারবেন না।
কবি বলিলেন, “তুমি দাও, আমি ঠিক পড়ব।”
কম্পিত হস্তে তাঁকে কবিতাটি দিলাম। কবি মনে মনে কবিতাটি পড়িতে লাগিলেন। আমার মনে হইল, পড়ায় বিশুদ্ধ উচ্চারণ হইবে না মনে করিয়াই তিনি আমাকে পড়িতে দিলেন না। কারণ, তিনি এতটুকু উচ্চারণ-দোষ সহ্য করিতে পারিতেন না। কবির নিজের নাটকে যাহার পাঠ লইতেন, কবির নিকট সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম উচ্চারণ শিখিতে তাহাদের প্রাণান্ত হইত। কবিতাটি পড়া শেষ হইলে তিনি বলিলেন, ‘বেশ হয়েছে।’
আমি বলিলাম, ‘কবিতাটিতে ত্রিপদী ছন্দ একটু নতুন ধ্বনিতে রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করেছি।’
তিনি লেখাটিতে কিছুক্ষণ চোখ বুলাইয়া উত্তর করিলেন, ‘তা এটিকে নতুন ছন্দ তুমি বলতে পার।’
রবীন্দ্রনাথ আমাকে দেখিলেই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা লইয়া আলোচনা করিতেন। তিনি বলিতেন, দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে দিলেই যে ঘরে আগুন লাগে, তার কারণ সেই ঘরের মধ্যে বহুকাল আগুন সঞ্চিত ছিল। যাঁরা বলতে চান, আমরা সবাই মিলমিশ হয়ে ছিলুম ভাল, ইংরেজ এসেই আমাদের মধ্যে আগুন ধরিয়ে দিল–তাঁরা সমস্যাটিকে এড়িয়ে যেতে চান।
একদিন বন্দেমাতরম্ গানটি লইয়া কবির সঙ্গে আলোচনা হইল। কবি বলিলেন, বন্দেমাতরম্ গানটি যে ভাবে আছে, তোমরা মুসলমানেরা তার জন্য আপত্তি করতে পার। এ গানে তোমাদের ধর্মমত ক্ষুণ্ণ হওয়ার কারণ আছে।
এর পরে ‘বন্দেমাতরম্ গান লইয়া হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে খুব বিবোধ চলিতেছিল। কলিকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউটে ‘বন্দেমাতরম্’ গান লইয়া মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে এক প্রতিবাদসভা বসে। সেই সভার কথা শুনিয়া শ্বীমতী হেমপ্রভা মজুমদার সাম্প্রদায়িক মিলনের উপর এক সুন্দর বক্তৃতা করেন। মুসলমান ছাত্রেরা শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁহার বক্তৃতা শোনে এবং তাহাদের প্রতিবাদের বিষয়টিও তাহাকে বুঝাইয়া বলে। সেই সভায় আমি খুব অভিমানের সঙ্গেই বলিয়াছিলাম, আজ ‘বন্দেমাতরম গান নিয়ে আমাদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রকাণ্ড বিরোধের উপক্রম হয়েছে। কখন যে এই বিরোধ অগ্নি-দাহনে জ্বলে ওঠে, কেউ বলতে পারে না। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই গান নিয়ে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। কবি এ কথা স্বীকার করেছিলেন, বন্দেমাতরম্ গানে আপত্তি করবার মুসলমানদের কারণ আছে। কিন্তু আজ জাতি যখন এই ব্যাপার নিয়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে, তখন কবি কেন নীরব আছেন? তিনি কেন তার মতামত ব্যক্ত করছেন না?
আমার বক্তৃতার এই অংশটি কোন পত্রিকায় উদ্ধৃত করিয়া উহার সম্পাদক আমাকে সাম্প্রদায়িক বলিয়া প্রমাণ করিতে ও রবীন্দ্রনাথের বিরাগ উৎপাদন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন।
ইহার অল্প দিন পরে কলিকাতায় সর্বভারতীয় জাতীয় মহাসভার কার্যকরী সমিতির অধিবেশন বসে; তখন ‘বন্দেমাতরম্’ গান লইয়া তুমুল আন্দোলন হয়। সেই সময়ে একদিন বন্ধুবর সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলিলাম, রবীন্দ্রনাথ নিজে স্বীকার করেছেন, বন্দেমাতরম গানে মুসলমানদের আপত্তির কারণ আছে। আজ সারা দেশ এই গান নিয়ে বিরাট সাম্প্রদায়িক কলহের সম্মুখীন হচ্ছে। এখন তো কবি একটি কথাও বলছেন না।
সৌম্যেন্দ্রনাথ বলিলেন, “জহরলাল নেহেরু গানটি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়েছিলেন। কবির পরামর্শের ফলে এ গানে তোমাদের আপত্তিজনক অংশটি কংগ্রেসের কোন অনুষ্ঠানে আর গীত হবে না”।
রবীন্দ্র-জয়ন্তীর পর কবি কিছুদিন অসুস্থ হইয়া পড়েন। এই অসুস্থ অবস্থার মধ্যে কবি শিল্পীদলের অভিদন্দন গ্রহণ করেন। অভিনন্দন-সভা ঠাকুরবাড়ির হলঘরে বসিয়াছিল। ‘নন্দলাল প্রমুখ। শিল্পীরা প্রত্যেকে কবিকে এক একখানা করিয়া চিত্র উপহার দিয়াছিলেন। উহার পর কিছুদিনের জন্য কবি আর কোন অনুষ্ঠানে যোগদান করেন নাই। এই সময়ে আমি প্রায়ই কবির সঙ্গে দেখ করিতে যাইতাম। আমাকে দেখিলেই কবি সাম্প্রদায়িক ব্যাপার লইয়া আলোচনা করিতেন। বলিতেন কেন যে মানুষ একের অপরাধের জন্যে অপরকে মারে! ও-দেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের মারল, তাই এদেশের হিন্দুরা এখানকার নিরীহ মুসলমানদের মেরে প্রতিবাদ জানাবে এই বর্বর মনোবৃত্তির হাত থেকে দেশ কি ভাবে উদ্ধার পাবে বলতে পার? কী সামান্য ব্যাপার নিয়ে মারামারি হয়—গরু-কোরবানী নিয়ে, মসজিদের সামনে বাজনা নিয়ে। একটা পশুকে রক্ষা করতে মানুষ মানুষকে হত্যা করেছে।”
এই সব আলোচনা করিতে কবি মাঝে মাঝে বড়ই উত্তেজিত হইয়া উঠিতেন। একদিন আমি কবির সঙ্গে দেখা করিতে যাইতেছি, কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথ আমাকে একান্তে ডাকিয়া বলিলেন, এখন বাবার শরীর অসুস্থ। আপনাকে দেখলেই তিনি হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। মাঝে মাঝে তাতে উত্তেজিত হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীরে এই উত্তেজনা খুবই ক্ষতিকর। আপনি কিছুদিন বাবার সঙ্গে দেখা করবেন না।
তখনকার মত আমি কবির সঙ্গে দেখা করিলাম না।
মুসলমানদের প্রতি কবির মনে কিছু ভুল ধারণা ছিল। তিনি সাধারণত হিন্দু পত্রিকাগুলিই পড়িতেন। মুসলমানি পত্রিকার একআধ টুকরা মাঝে মাঝে কবির হাতে পড়িত।
কবির ভুল ধারণার প্রতিবাদ করিয়া উপযুক্ত কারণ দেখাইলেই কবি তাঁহার ভুল সংশোধন করিয়া লইতেন। কবির মনে একদেশদর্শী হিন্দুত্বের স্থান ছিল না। মুসলমানদের মধ্যে যাঁহারা স্বাধীন মতবাদ লইয়া ধর্ম ও সমাজ-ব্যবস্থার সমালোচনা করিতেন, তাহাদের প্রতি কবির মনে প্রগাঢ় অনুরাগ ছিল। কিন্তু কবির নিকটে যাঁহারা আসিতেন, কবি শুধু তাহাদিগকেই জানিতেন। এই বয়সে ইহার বেশি খবরাখবর লওয়া কবির পক্ষে সম্ভবও ছিল না।