একবার রংপুরে গিয়াছি গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করিতে। শুনিলাম ক্ষিতিমোহন আসিয়াছেন সেখানে বক্তৃতা করিতে। গিয়া দেখা করিলাম। তিনি সস্নেহে আমাকে গ্রহণ করিলেন। গ্রাম্য-গান সংগ্রহের বিষয়ে তাঁর কাছে উপদেশ চাহিলাম। তিনি সাধক রজবের একটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়া তার ব্যাখ্যা করিলেন। সাধনের কথা সেই যেন জিজ্ঞাসা করে যে নিজের হাতে নিজের ছের কেটে এসেছে। তোমার আত্মীয়স্বজন বলবে, এইভাবে তুমি কাজ কর যাতে তোমার খ্যাতি হয়। অর্থাগম হয়। তোমার দেশবাসী বলবেন, এইভাবে কাজ কর—আমরা তোমাকে যশে উচ্চ শিখরে নিয়ে যাব। তোমার লৌকিক ধর্ম বলবে, এইভাবে কাজ কর—তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাব। তোমার দৈহিক অভাব-অভিযোগ বলবে, এইভাবে কাজ করলে তোমার অর্থাগম হবে—কোন দুঃখ-দরিদ্র থাকবে না। এই সমস্তকে অতিক্রম করে তুমি তোমার আত্মার যে ধর্ম তারই পথ অনুসরণ করে চলবে। মনে মনে ভাববে, কি তোমার করণীয় কি করতে তুমি এসেছ। রাজভয়, লোকভয়, আত্মপরিতৃপ্তি কিছুই যেন তোমাকে তোমার পথ হতে বিভ্রান্ত করতে পারে না। ছের কেটে দিয়ে তবে তোমার সাধনের পথে অগ্রসর হতে হবে।
ক্ষিতিমোহনের এই উপদেশ আজও আমার অন্তরে ধ্বনিতপ্রতিধ্বনিত হইতেছে।
শান্তিনিকেতনে থাকিয়া এখানে ওখানে ঘুরিয়া সময় কাটাই। পরিচয় হইল শান্তিদেব ঘোষের সঙ্গে। তখন তার কৈশোরকাল। এমন মধুর কণ্ঠ! তাকে ডাকিয়া লইয়া খোয়াই নদীর ধারে বসি। আকাশের শূন্য পথে দু-একটি পাখী উড়িয়া যায়। নদীর ওপারে সাঁওতালমের গ্রামে দিনের আলো ম্লান হইয়া আসে। শান্তি গানের পর গান গাহিয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের গান কলিকাতায় বহু লোকে মুখে শুনিয়াছি। কিন্তু শান্তির কণ্ঠে রবীন্দ্র-সংগীতের যে ঢংটি ফুটিয় ওঠে, এমন আর কোথাও পাই না। সে গানের সুরকে কণ্ঠের ভিত লইয়া ঘষিয়া ঘষিয়া কেমন যেন পেলব করিয়া দেয়। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ণ সুরের বুনোট-কার্য শূন্য বাতাসের উপর মেলিয়া ধরিয়া শান্তি গান গাহিয়া চলে। গানের কথা-সুরের অপূর্ব কারুকারিতা যেন রামধনুকের রেখা লইয়া মনের উপর রঙের দাগ কাটতে থাকে মনে হয়, জীবনে যা-কিছু পাই নাই—যার জন্য দুঃখের আর জ্বালাইয়া সুদীর্ঘ বেঘুম রজনী জাগিয়া কাটাইয়াছি, সেই বেদনা কাহিনী বুঝি সুরের উপর মেলিয়া, ধরিয়া ক্ষণিকের তৃপ্তিলাভ বলা যায়। দুই চোখ বহিয়া ধারার পর ধারা বহিতে থাকে। শান্তি অবাক হইয়া গান বন্ধ করে। আবার তাহাকে সাধ্যসাধন করিয়া গান গাওয়াই। বহুকাল পরে এবার বোম্বাই রবীন্দ্র-শতবার্ষিকীতে শান্তি আসিয়াছিল গান গাহিতে। কণ্ঠস্বরটি তার আগের মতই সুন্দর আছে। দুই বন্ধুতে মিলিয়া একদিন প্রায় সারারাত্রি নানা রকমের গানের সুর-বিস্তারের উপর আলোচনা করিলাম। শুধু কি তাই—মাঝে মাঝে আমাদের বিগত জীবনের সেই খোয়াই নদী তীরের কাহিনী কি আসিয়া মনকে দোলা দিল না?
সেবার শান্তিনিকেতনে আরও দুইটি মেয়ের গান শুনিলাম। খুকু আর নুটুদির গান। মলিন চেহারার মেয়ে খুকু। গান গাহিতে বলিলেই গান গাহে, সাধ্যসাধনা করিতে হয় না। ওর হৃদয়ে যেন কোন ক্রন্দন লুকাইয়া ছিল। গান গাহিতে বলিলেই সেই ক্রন শ্রোতার মনে ঢালিয়া দিয়া সে হয়ত তৃপ্তি পাইত। খুকু আর ইহজগতে নাই। অতি অল্প বয়সে সে তার শ্রোতাদের নিকট হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিয়া হয়ত কোন দেবসভায় মরধামের গান বিতরণ করিতেছে।
নুটুদির গান শুনিলাম বর্ষামঙ্গলের মহড়ায়। গানের মহড়ায় বাইরের লোক যাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু দিনুদাকে (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) বলিতেই তিনি সহাস্যে অনুমতি দিলেন। নুটুদির মুখে যাহারা রবীন্দ্রসংগীত না শুনিয়াছেন, তাহাদের দুর্ভাগ্য। গানের কোন কোন স্থানে সুরকে তিনি এমন সরু করিয়া লইতেন যেন তা বোঝা যায় কি যায় না। রবীন্দ্র-জয়ন্তীর সময় কখনো দিলে পরায়ে গোপনে ব্যথার মালা—বিরহ মালা’ গানটি তিনি বড় সুন্দর করিয়া গাহিয়াছিলেন, তেমন আর কোথাও শুনি নাই। নুটুদির বিবাহ হইল বন্ধুবর সুরেন করের সঙ্গে। তাঁর আঁকা ‘সাথী’ ছবিটি জগৎ-বিখ্যাত। সেই ছবি তিনি হাসিমুখে আমার রাখালী’ পুস্তকের কভারে ব্যবহার করিবার অনুমতি দিয়াছিলেন। শুনিলাম সন্তান-সম্ভাবনার সময় নুটুদি মারা গিয়াছেন। সে কালের রবীন্দ্রসংগীত গাহিবার জন্য বোধ হয় এক শান্তিদেব ঘোষই আছে। একদিন রবীন্দ্রনাথ দিনুদাকে বলিতেছেন, শুনিয়াছিলাম, শান্তির উপর একটু বেশি নজর দিস। আমাদের পরে ওই ত আমার গানের ভাণ্ডারী হবে।
এইভাবে গান শুনি–নিশিকান্ত আর সান্ত্বনার সঙ্গে আড্ডা জমাই সেই বয়সটায় কথার অভাব হয় না। ঘরের কথা, পরের কথা, হাটের কথা, ঘাটের কথা—সমস্ত কথা মিলাইয়া কথার সরিৎসাগর জমাই। শান্তিনিকেতনের শিক্ষকেরা দেখা হইলে হাতজোড় করিয়া অভিবাদন জানান, কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। সবাই আমার উপর তুষ্ট। কোথাও কোন আবিলত নাই। নিশিকান্ত বলে, ‘জসীম তুমি এখানে একটা মাস্টারি নিয়ে থেকে যাও। আমিও কতকটা নিমরাজি হই। ইস্কুল-কলেজ বন্ধ। কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলিবে কে জানে। মন্দ কি! কিছুদিন মাস্টারি করিলে ক্ষতি কি। দুই বন্ধু আমার জন্য দরবার করে।
রবীন্দ্র-জয়ন্তীর পরে কবি কিছুদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অবস্থান করেন। এই সময় আমি প্রায়ই কবির সঙ্গে দেখা করিতে যাইতাম। একদিন কবিকে গিয়া বলিলাম, “আমরা আপনাকে মনে মনে কি ভাবে কল্পনা করি তা হয়ত আপনার জানতে ইচ্ছা করে। আপনার উপর নতুন ছন্দে একটি কবিতা লিখেছি। যদি বলেন তো পড়ে শুনাই।”