একবার হাসু গড়াইতে আসিয়াছিল যাদবপুরে তাদের আত্মীয় ডাঃ হীরালাল রায়ের বাড়িতে। সেখানে গিয়া হাসুর সঙ্গে দেখা করিলাম। শ্রীমতি রায় আদর করিয়া আমাকে গ্রহণ করিলেন। তার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হারই মত আমার আপন হইয়া উঠিল। তাদের সঙ্গে নিয়া গল্প গুজব করিয়া সারাদিন কাটাইয়া আসিলাম।
এইভাবে দিনের পর দিন বছরের পর বছর ঘুরিয়া চলিল। ছয় মাস পরে, এক বছর পরে, সুযোগ পাইলেই আমি শান্তিনিকেতনে আসি। হাসুর সঙ্গে দেখা হয়।
সেবার সিভিল-ডিস্ওবিডিয়েন্স আন্দোলনে ইস্কুল-কলেজ বন্ধ হইয়া গেল। আমি মাসখানেকের জন্য শান্তিনিকেতনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। হাসু বড় হইয়াছে। ডাকিলে কাছে আসিতে চায় না। সে যে বড় হইয়াছে, একথা আমি যেন ভাবিতেই পারি না। রবীন্দ্রনাথের কাবুলীওয়ালা’র মত আজ আমার মনের অবস্থা। বুঝিলাম বীণা-যন্ত্রের কোন অজ্ঞাত ‘তার যেন ছিড়িয়া গিয়াছে। সুধাদি কত ডাকিলেন হাসুর মা সুন্দরদি কত ডাকিলেন। অনেক ডাকাডাকির পর হাসু আসিয়া সামনে দাঁড়াইল। সেই মমতা-মাখানো মুখখানি তেমনি আছে। আজ আদর করিয়া তাহাকে কাছে ডাকিতে পারি না। ছড়ার ঝুমঝুমি বাজাইয়া তাহাকে খুশি করিতে পারি না। হাসুর বন্ধুরা সকলেই আসিল। মমতা আসিল-অনু, মিনু আসিল, কিন্তু গল্পের আসর যেন তেমন করিয়া জমিল না। নিজের আস্তানায় আসিয়া কোন্ সাত সাগরের কান্নায় চোখ ভাসিয়া যাইতে লাগিল। কেন ও বড় হইল? কেন ও আগের মত ছোটটি হইয়া রহিল না? এমনি প্রশ্নমালায় সমস্ত অন্তর মথিত হইতে লাগিল। এই মেয়েটি যদি আসিল—আমার বোনটি হইয়া আসিল না কেন! আমার কোলের মেয়েটি হইয়া আসিল না কেন! যে কার অভিশাপে চিরজন্মের মত পর হইয়া গেল।
কলিকাতা আসিয়া পলাতক’ নামে একটি কবিতা লিখিলাম। হাসু নামে ছোট্ট একটি খুকু আজ যে কোথায় পলাইয়া গিয়াছে! খেলাঘরের খেলনাগুলি তেমনি পড়িয়া রহিয়াছে। এখানে সে আর খেলা করিতে আসিবে না। সে যে পলাইয়া গিয়াছে তা তার বাপ জানে না, মা জানে না, তার খেলার সাথীরা জানে না, সে নিজেও জানে না। কোন সুদূর তেপান্তরের বয়স তাহাকে আজ কোথায় লইয়া গিয়াছে। কোনদিনই সে আর খেলাঘরে ফিরিয়া আসিবে না। কবিতাটি শেষ করিয়াছিলাম একটি গ্রাম্য ছড়া দিয়া—
এখানটিতে খেলেছিলাম ভাঁড়-কাটি সঙ্গে নিয়ে
এখানটি রুধে দে ভাই ময়নাকাঁটা পুতে দিয়ে।
কবিতাটি ‘আহেরিয়া’ নামে একটি বার্ষিক কাগজে ছাপা হইলে হাসুকে একখানি বই পাঠাইয়াছিলাম। হাসু একটি সংক্ষিপ্ত পত্রে উত্তর দিয়াছিল—‘জুসীদা, তোমার কথা আমি ভুলি নাই। আমার শিশুকালে তুমি গল্প-কবিতা শুনিয়েছ, ছোট বয়সের স্মৃতির সঙ্গে তোমার কথাও আমি কোনদিন ভুলব না।
হাসুকে লেখা কবিতাগুলি দিয়া আমার হাসু পুস্তকখানি সাজাইলাম। ভাবিয়াছিলাম, এই পুস্তক রবীন্দ্রনাথের নামে উৎসর্গ করিব। কারণ তাঁহারই আশ্রমকা হাসুর উপরে কবিতাগুলি লিখিয়াছি। পরে ভাবিয়া দেখিলাম, রবীন্দ্রনাথকে তে কত লেখকই বই উৎসর্গ করে। এ বই পড়িয়া সব চাইতে খুশি হইবেন আমার জননীসম সুধাদি আর হাসুর মা সুন্দরদি। বইখানি ইহাদের নামে উৎসর্গ করিলাম। সুধাদির কথা ভাবিলে আজও আমার নয়ন অশ্রুভারাক্রান্ত হইয়া আসে। এই সর্বংসহা দেবীপ্রতিমা কত আধপাগলা, ক্ষ্যাপা, স্নেহপিপাসু ভাইদের ডাকিয়া আনিয়া তাঁর গৃহের স্নেহ-ছায়াতলে যে আশ্রয় দিয়াছেন,তাহার ইয়ত্তা নাই।
আমি হাসুকে বেশী আদর করিতাম। তার জন্য কলিকাতা হইতে বই-পুস্তক পাঠাইত; সুধাদির ছোট ছোট ছেলেদের জন্য কিছুই পাঠাইতাম না। ছেলেরা কিন্তু হিংসা করিত না, সুধাদিও বিরক্ত হইতেন না। সুধাদি ছাড়া যে কোন ছেলের মা এমন অবস্থায় আমার জন্য গৃহ দ্বার বদ্ধ করিতেন। সুধাদি—আমার এমন সুধাদির কথা বলিয়া ফুরাইতে চাহে না। কতদিন সঁহাদের সহিত জানাশুনা নাই। সুধাদি এখন কেমন আছেন জানি না। কিন্তু আমার মনের জগতে সুধাদি প্রভাতদা তাঁদের দুই ছেলে সুপ্রিয় দেবপ্রিয়, আর হালু হাত ধরাধরি করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়।
প্রভাতদার মত অত বড় পণ্ডিত ব্যক্তি সামান্য বেতনে শান্তিনিকেতনের আশ্রমে গ্রন্থাগারিকের কাজ করিতেন। সংসারের অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। তাই সুধাদিকেও শিক্ষকতার কাজ করিতে হইত। ঘরসংসারের কাজকরিয়া ছেলেদের দেখাশুনা করিয়া শিক্ষকতার কাজ করিয়া তার উপরেও দিদি হাসিমুখে আমাদের মত ভাইদের নানা স্নেহের আবদার সহ করিতেন। ডাকিয়া এটা-ওটা খাওয়াইতেন। তাঁর হাসিমুখের ‘ভাই’ ডাকটি শুনিয়া পরাণ ভরিয়া যাইত। প্রভাতদা অন্যত্র এখানকার বহুগুণ বেতনে চাকুরীর ‘অফার পাইয়াছিলেন, কিন্তু কবিগুরুর আদর্শকে রূপায়িত করিতে সাহায্য করিতেছেন বলিয়া তিনি অন্যত্র যান নাই।
শান্তিনিকেতনে আরও কয়েকজন প্রতিভাবান ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের আদর্শবাদের রূপায়ণে তিলে তিলে নিজদের দান করিয়া গিয়াছেন। একজন জগদানন্দ রায়—গ্রহ-নক্ষত্রের কথা, বিজ্ঞানের কথা এমন সুন্দর করিয়া সহজ করিয়া লিখিবার লোক আজও বাঙালীর মধ্যে হইল না। তার বইগুলি বাজারে দুষ্প্রাপ্য। বাঙালীর ছেলেমেয়ে দের এর চাইতে দুর্ভাগ্যের আর কিছু নাই। চেহারায় ব্যবহারে একেবারে কাঠখোটা মানুষটি, কিন্তু দুরূহ বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলিকে তিনি জলের মত সহজ করিয়া লিখিতে পারিতেন। আরও একজনের নাম করিব—স্বর্গীয় ক্ষিতিমোহন সেন। এমন মধুর কথকতা করিতে বুঝি আর কোথাও কাহাকে পাওয়া যাইবে না। তার গবেষণা বিষয়ে আমার মতানৈক্য আছে, কিন্তু তাঁর ব্যবহারে কথায় বার্তায় যেন শ্বেতচন্দন মাখানো ছিল। তাঁর সঙ্গে ক্ষণিক আলাপ করিলেও সেই চন্দনের সুবাস সারাজীবন লাগিয়া থাকিত।