সকালে নিশিকান্ত, সান্ত্বনা আর তাদেরই মত যত পাগলাটে ছেলেদের আশ্রয়স্থল শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগারিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি আসিয়া হাজির হইলাম। সেখানে প্রভাত কুমারের স্ত্রী সুধা-দিদি হাসিমুখে আমাদিগকে গ্রহণ করিলেন। তাঁর ছোট ঘোট দুই ছেলে, সুপ্রিয় দেবপ্রিয় আব প্রভাত কুমারের ভাইঝি হাসু আসিয়া আমাদের সমনে দাঁড়াইল। সুতরাং আমাকে আর পায় কে! গল্পের উপরে গল্প চলিল। কবিতার উপরে কবিতা আবৃত্তি হইতে লাগিল। আমি আর নিশিকান্ত, নিশিকান্ত আর আমি দুইজনে পালা করিয়া মনের সাধ মিটাইয়া গল্প বলিয়া চলিলাম। পাশের ঘরে বইপুস্তক লইয়া প্রভাতদা মশগুল হইয়াছিলেন। আমাদেয় এই হৈ-হুল্লোড় যখন চরমে উঠিতেছিল তিনি মাঝে মাঝে আমাদের দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিতেছিলেন।
সুধা-দি আমাকে বিকালে চায়ের নিমন্ত্রণ করিলেন। সকালে আমরা গল্প বলিয়া, কবিতা আবৃত্তি করিয়া ছোটদের আকর্ষণ করিয়াছি। এইবার তাদের পালা। হাসু, হাসুর বন্ধু মমতা, হাসুর দিদি অনু আরও ছোট ছোট কয়েকটি ছেলেমেয়ে হাত ধরাধরি করিয়া এমন সুন্দর নাচ দেখাইল! সুধাদি তাঁর এস্রাজ বাজাইয়া সেই নাচের আবহসংগীত পরিবেশন করিলেন। মনে হইল এইসব ছেলেমেয়েরা যেন কতকাল আমার পরিচিত। তখনও আমার ছেলেমেয়ে হয় নাই। মনের বাৎসল্যসুধা তাই পরের ছেলেমেয়ে দেখিলে উৎসারিত হইয়া উঠিত।
প্রভাতদার ভাইঝি হাসুর বয়স তখম পাঁচ-ছয় বছর। তার মুখখানা এমন করুণ মমতা মাখানো! কাছে ডাকিয়া আদর করিলে আদর করিতে দেয়। আমার হৃদয়ের সুপ্ত বাৎসল্য-স্নেহ এই ছোট্ট মেয়েটিকে ঘিরিয়া গুঞ্জন করিয়া উঠিল। হাসুকে কাছে ডাকিয়া বলিলাম, “তোমার সঙ্গে আমার খুব ভাব। না দিদি?” ডাগর ডাগর চোখ দুটি মেলিয়া হাসু চাহিয়া রহিল। বিদায়ের দিন তাকে ডাকিয়া বলিলাম, “হাসু! কলকাতা গিয়ে আমি তোমাকে চিঠি লিখবো। তুমি উত্তর দেবে তো? হা ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। এই ভাবে সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরিয়া শান্তিনিকেতনের ছেলেদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করিয়া সন্ধ্যার আগে প্রভাতদার বাসায় আসিলাম। বার-তের বছরের ছোট একটি মেয়ে প্রভাতদার বাড়িতে আসিয়া আমার সঙ্গে দেখা করিল। তার কবিতার খাতাটি আমাকে দেখাইল। ছন্দের হাতটি তখনো পাকা হয় নাই। আমি তাহাকে খুব উৎসাহ দিলাম। সুধাদি বলিলেন, ‘মেয়েটি ভাল গান করে, ওর গান শুনবে?’
মেয়েটি অনেক কষ্টে লজ্জা কাটাইয়া অতুলপ্রসাদের রচিত একটি গান গাহিল। “ওগো, সাথী, মম সাথী, আমি সেই পথে যাব তব সাথে।’ সে কি গান, না দূর-দূরান্তর হইতে ভাসিয়া-আসা কোন নাম-না-জানা পাখীর কণ্ঠস্বর! গান শেষ-করিয়া মেয়েটি সুন্দর হাত দুইটি তুলিয়া আমাকে নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল। পাতলা একহারা চেহারা, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম। নতুন ধানের পাতার সমস্ত বর্ণসুষমা কে যেন তাহার সমস্ত গায়ে মাখাইয়া দিয়াছে। মনে হইল, এমন গান কোনদিন শুনি নাই। এমন রূপও বুঝি আর কোথাও দেখি নাই। আজও তার গানের রেশ আমার কানে লাগিয়া আছে। আমার সোজন বাদিয়ার ঘাট’ পুস্তকে নায়িকার রূপ বর্ণনা করিতে আমি এই মেয়েটিকে মনে মনে কল্পনা করিয়াছিলাম। পুস্তকের দুইটি অংশ প্রত্যেক অংশের আগে অতুলপ্রসাদের এই গানটি আমি উদ্ধৃত করিয়া দিয়াছিলাম। মেয়েটি আজ কোথায় আছে জানি না। হয়ত কোন সুন্দর স্বামীর ঘরণী হইয়া ছেলেমেয়ে লইয়া সুখে আছে। সে কোনদিনই জানিতে পারিবে না
যে তার সেই ক্ষণিকের দর্শন আর সুমধুর গান আমাকে সুদীর্ঘ সোজন বাদিয়ার ঘাটের কাহিনী লিখিতে সাহায্য করিয়াছিল। আমার এই পুস্তক সে হয়ত অপর দশজনের মতই বাজার হইতে কিনিয়া পড়িয়াছে, অথবা পড়ে নাই। নিজে তাহাকে এই বই উপহার দিয়া তাহার মতামত জানিবার সুযোগ কোনদিনই হইবে না। লেখকজীবনে এমনি বেদনার ঘটনা প্রায়ই ঘটিয়া থাকে।
চার-পাঁচ দিন শান্তিনিকেতনে থাকিয়া কলিকাতা চলিয়া আসিলাম। বিদায়ের দিন হাসুকে কাছে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, হাসু, তোমাকে আমি চিঠি লিখব—কবিতা করে ছড়া কেটে চিঠিতে চিঠিতে তোমার সঙ্গে কথা বলব। তুমি উত্তর দেবে তো? ঘাড় নাড়িয়া হাসু জানাইল, সে উত্তর দিবে।
এর আগে আমি ছোটদের জন্য কবিতা লিখি নাই। কলিকাতা আসিয়া হাসুকে খুসি করিবার জন্য ছোটদের উপযোগী কবিতা লেখায় হাত দিলাম। আমার যেন দিনরাত্রের তপস্যা হইল, ওই একরত্তি ছোট্ট মেয়েটিকে খুসি করা। ছড়া কাটিয়া নানা ছন্দে ভরিয়া হাসুকে পত্র লিখিতে লাগিলাম। ছোট্ট মেয়ে। তার সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলায় সময় কাটায়। আমার এই অসংখ্য পত্রের উত্তর দেওয়ার সময় কোথায়? তবু মাঝে মাঝে আকাবাঁকা হাতের ছোট্ট এক একখানা চিঠি সে আমাকে পাঠাইত। সেই সব পত্র পাইয়া আমি যেন সাত রাজার ধন হাতে পাইতাম। চিঠি অবলম্বন করিয়া মনে মনে কল্পনার রথকে উধাও ছুটাইতাম। ইহাতেও মনের আশা মিটিত না। অবসর পাইলেই শান্তিনিকেতনে গিয়া উপস্থিত হইতাম। যাইবার আগে কোন্ কোন্ গল্প বলিয়া হাসু আর তার বন্ধুদের খুসি করিব, বারবার মনে আওড়াইয়া লইতাম। সেখানে গিয়া সুধাদির বাড়িতে পূর্বের মতই আমার গল্পের আসর বসিত। মাঝে মাঝে কলিকাতা হইতে ছোটদের জন্য লেখা বই কিনিয়া হাসুকে পাঠাইতাম। উপহার-পৃষ্ঠায় গবাদাকে দিয়া অথবা প্রশান্তকে দিয়া রঙ-বেরঙের ছবি আঁকাইয়া লইতাম।