ইহার কিছুদিন পরে খালাআম্মা সেই যে কোথায় চলিয়া গেলেন, কিছুতেই তাহার খোঁজ পাওয়া যায় নাই। আজ দুই-তিন-বৎসরের উপরে খালা-আম্মা উধাও। কবির দুই পুত্র কত স্থানে তাহার অনুসন্ধান করিতেছে, তাঁহাকে পাওয়া যায় নাই।
দু-একজন কৃত্রির নজরুল-ভক্তের মুখে আজও খালাআম্মার নিন্দা শোনা যায়। তাঁহারা বলিয়া থাকেন, “নজরুলের টাকা সমস্ত তার শাশুড়ীর পেটে।” বিনা অপরাধে এরূপ শাস্তি পাইতে আমি আর কাহাকেও দেখি নাই। রক্ষণশীল হিন্দু-ঘরেব এই বিধবা নিজের মেয়েটির হাত ধরিয়া একদিন এই প্রতিভাধর ছন্নছাড়া কবির সঙ্গে অকূলে ভাসিতেছিলেন। নিজের সমাজের হাতে আত্মীয়-স্বজনের হাতে সেদিন তাহার গঞ্জনার সীমা ছিল না। সেই লাঞ্ছনা-গঞ্জনাকে তিনি তৃণের মত পদতলে দলিত করিয়াছেন। কিন্তু পরবর্তী নিন্দা অন্য ধরনের। এই নিন্দা তিনি সহ করিতে পারিলেন না।
খালাআম্মা আজ বাঁচিয়া আছেন কিনা জানি না, ইহলোকে বা পরলোকে যেখানেই থাকুন, তিনি যেন তার এই পাতান বোনপোটির একফোটা অশ্রুজলের সমবেদনা গ্রহণ করেন। মুহূর্তের জন্যও যেন একবার স্মরণ করেন, ভাল কাজ করিলে তাহা বৃথা যায় না। খালাম্মার সেই নীরব আত্মত্যাগ অন্তত পক্ষে একজনের অন্তরের বীণায় আজও মধুর সুরলহরে প্রকাশ পাইতেছে।
আমার ভাবী সাহেবার কথা আর কি বলিব! কত সীমাহীন দুঃখের সাগরেই না তিনি ভাসিয়া চলিয়াছেন! অর্ধাঙ্গ হইয়া তিনি বিছানা হইতে উঠিতে পারেন না। তবু মুখে সেই মধুর হাসিটি যে হাসি সেই প্রথম বধূজীবনে তাঁহার মুখে দেখিয়াছিলাম। যে হাসিটি দিয়া ছন্নছাড়া কবিকে গৃহের লতা শৃঙ্খলে বাঁধিয়াছিলাম। যে হাসিটির বিনিময়ে আকাশের চাঁদ হইতে, সন্ধ্যা-সকালের রঙিন মেঘ হইতে নুড়ি পাথর কুড়াইয়া আপন বুকের স্নেহমমতায় শিশু কুসুমগুলি গড়িয়া কবির কোলে সাজাইয়া দিয়াছিলেন। সেই হাসি এখনও তাঁহার মুখ হইতে ম্লান হইয়া যায় নাই।
রোগগ্রস্ত কবি প্রায় অধিকাংশ সময় ভাবীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া পুরাতন পুস্তকের পাতা উল্টাইতে থাকেন। হায়রে, কবির অতীত জীবন-নাট্যের বিস্মৃত পাতাগুলি আর কি তাহার কাছে অর্থপূর্ণ হইয়া উঠিবে?