আমার বক্তৃতার শেষের দিকে আমি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মহাশয়ের কঠোর সমালোচনা করিয়াছিলাম। পরদিন তিনি আমাকে ডাকাইয়া ইহার জন্য কৈফিয়ৎ চাহিলেন। আমি তাহাকে বলিলাম, “আপনার কাছে যে শিক্ষা পেয়েছি, তারই জোরে সভায় আপনার বিরূপ সমালোচনা করতে সাহসী হয়েছিলাম। আপনিই তো বলে থাকেন, আমরা রাজভয়ে ন্যায়ের পথ হতে বিচ্যুত হব না। কিন্তু পুলিশ-সাহেবের একখানা পত্র পেয়ে আপনি আপনার পুর্ব-অনুমতি ফিরিয়ে নিলেন।”
আমার কথা শুনিয়া তিনি হাসিয়া উঠিলেন। বুঝিলাম, তিনি আমাকে ক্ষমা করিয়াছেন। বস্তুত তাঁহার মত ক্ষমাসুন্দর শিক্ষক জীবনে খুব কমই দেখিয়াছি।
ইহার পরে আরও একবার কবি আমার বাড়িতে আসিয়াছিলেন। আমি ভাবিয়াছিলাম, আমাদের নদী-তীরের বাঁশঝাড়ের ছায়াতলে বসিয়া আমরা দু’টি কবি মিলিয়া উন্মুক্ত প্রকৃতির রহস্যদেশ হইতে মনি মাণিক্য কুড়াইয়া আনিব। কবিও তাহাতে রাজী হইয়াছিলেন। কিন্তু ফরিদপুরের তরুণ জমিদার বন্ধুবর লাল মিঞা সাহেব মোটর হাঁকাইয়া আসিয়া একদিন কবিকে শহরে লইয়া আসিলেন। আমার নদীতীরের চখা-চখির ডাকাডাকি কবিকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না।
বাঁশঝাড়ের যে স্থানটিতে কবির বসিবার আসন পাতিয়া দিয়াছিলাম, সেই স্থান শূন্য পড়িয়া রহিল। চরের বাতাস আছাড়িবিছাড়ি করিয়া কাঁদিতে লাগিল। আমার নদীতীরের কুটিরে কবির এই শেষ আগমন।
একদিন রাত্রে বন্ধুবর লাল মিঞার বাড়িতে আমরা তিন-চার জন মিলিয়া কবির সঙ্গে গল্প করিতে বসিলাম। কবি ভাল কবিতা লেখেন, ভাল বক্তৃতা দেন, ভাল গান করেন—তাহা সকলেই জানেন। কিন্তু মজলিসে বসিয়া যিনি কবির গালগল্প না শুনিয়াছেন, তাহারা কবির সব চাইতে ভাল গুণটির পরিচয় পান নাই। অনেক বড় বড় লোকের মজলিসে কবিকে দেখিয়াছি। মজলিসি গল্পে বিখ্যাত দেশবরণ্যে নেতা ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে কবিকে দেখিয়াছি; সেখানেও একমাত্র কথক কবি—আর সকলেই শ্রোতা। কথায় কথায় কবির সে কী উচ্চ হাসি! আর সেই হাসির তুফানে আশেপাশের সমস্ত লোক তাঁর হাতের পুতুলের মত একবার উঠিতেছে, একবার পড়িতেছে। কিন্তু এইদিন রাত্রে কবিকে যেন আরও নূতন করিয়া পাইলাম। কবির মুখে গল্প শুনিতে শুনিতে মনে হইল, কবির সমস্ত দেহটি যেন এক বীণার যন্ত্র। আমাদের দু-একটি প্রশ্নের মৃহ করাঘাতে সেই বীণা হইতে অপূর্ব সুরঝঙ্কার বাহির হইতেছে। কবি বলিয়া যাইতেছেন তাহার সমস্ত জীবনের প্রেমের কাহিনী। বলিতে বলিতে কখনও কবি আমাদের দুই চোখ অশ্রু-ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিতেছেন আবার কখনও আমাদিগকে হাসাইয়া প্রায় দম বন্ধ করিবার উপক্রম করিয়া তুলিতেছেন। সেসব গল্পের কথা আজো বলিবার সময় আসে নাই।
গল্প শুনিতে শুনিতে শুনিতে কোন দিক দিয়া যে ভোর হইয়া গেল, তাহা আমরা টের পাইলাম না। সকালবেলা আমরা কবিকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হইলাম।
একবার কবিকে আর একটি সভায় খুব গল্পমুখর দেখিয়াছিলাম। কবির এক গানের শিষ্য পুষ্পলতা দে’র জন্মদিনে। সেই সভায় জাহানারা বেগম, তাঁহার মা, কবির শাশুড়ী এবং কবি-পত্নী উপস্থিত ছিলেন।
আমরা সকলে খাইতে বসিয়াছি। ছোট ছোট মাটির পাত্রে করিয়া নানা রকম খাদ্যবস্তু আমাদের সামনে আসিয়া দেওয়া হইতেছে। কবি তার এক একটি দেখাইয়া বলিতেছেন—এটি খুড়ীমা, এট পিসীমা, এটি মাসীমা।
আমি কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আচ্ছা কবিভাই, সবাইকে দেখালেন—আমার ভাবী কোটি, তাকে তো দেখালেন না।”
কবি একটুও চিন্তা না করিয়া পানির গেলাসটি দেখাইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এইটি তোমাদের ভাবী ৷ যেহেতু আমি তার পাণিগ্রহণ করেছি।”
চারিদিকে হাসির তুফান উঠিল। ভাবী হাসিয়া কুটিকুটি হইলেন। কোন রকমে হাসি থামাইয়া আমরা আবার আহারে মনোনিবেশ করিয়াছি, অমনি কবি গম্ভীর হইয়া উঠিলেন : “জসীম, তুমি লুচি খেও না।”
বাড়ীর গৃহিণীর মুখ ভার। না জানি লুচির মধ্যে কবি কোন ত্রুটি পাইয়াছেন।
আমি উত্তর করিলাম, “কেন কবিভাই?” সকলেই ভোজন ছাড়িয়া কবির দিকে চাহিয়াছিলেন।
কবি বলিয়া উঠিলেন, “যেহেতু আমরা বেলুচিস্তান হতে এসেছি, সুতরাং লুচি খেতে পারব না।”
চারিদিকে আবার হাসির চোটে অনেকেরই খাদ্যবস্তু গলায় আটকাইয়া যাইতেছিল।
বাড়ীর গৃহিণী কৃত্রিম গলবস্ত্র হইয়া কবিকে বলিলেন, “বাবা নুরু, লক্ষ্মীটি, তুমি একটু ক্ষণের জন্য হাসির কথা বন্ধ কর। এদের খেতে দাও।”
আগেই বলিয়াছি, বিষয়বুদ্ধি কবির মোটেই ছিল না। একবার কবির বাড়ি গিয়া দেখি, খালাআম্মা কবিকে বলিতেছেন, “ঘরে আর একটিও টাকা নেই। কাল বাজার করা হবে না।”
কবি আমাকে সঙ্গে লইয়া চলিলেন তাঁর গ্রন্থ-প্রকাশকের দোকানে। পথে আসিয়া কবি ট্যাক্সি ডাকিলেন। কলেজ ষ্টীটের কাছে আসিয়া আমাকে ট্যাক্সিতে বসাইয়া রাখিয়া চলিলেন কলেজ ঈটি মার্কেটের দ্বিতল কক্ষে “আর্যস্থান পাবলিশিং হাউসে টাকা আনিতে। প্রায় আধ ঘণ্টা কাটিয়া গেল, কবির দেখা নাই। এদিকে ট্যাক্সিতে মিটার উঠিতেছে। যত দেরী হইবে, কবিকে তত বেশী ট্যাক্সী ভাড়া দিতে হইবে। বিরক্ত হইয়া আমি উপরে উঠিয়া গেলাম। দেখি, কবি প্রকাশকের সঙ্গে একথা-ওকথা লইয়া আলাপ করিতেছেন। আসল কথা—অর্থাৎ টাকার কথা সেই গল্পের মধ্যে কোথায় হারাইয়া গিয়াছে। কবির কানে কানে আমি সমঝাইয়া দিলাম, কিন্তু কবির সেদিকে খেয়াল নাই তখন রাগত ভাবেই বলিলাম, “ওদিকে ট্যাক্সির মিটার উঠছে, সেটা মনে আছে?” কবি তখন প্রকাশকের কানে কানে টাকার কথা বলিলেন।