“বাপ তো “বাক। হঠাৎ ছেলের মন ঘুরে গেল কি করে? ছেলের কোন বন্ধুর মারফৎ বাপ জানতে পারলেন, যে-মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ের কথা স্থির হয়েছিল তাকে দেখেই সে পাগল। তখন বাপ ছুটলেন মেয়ের বাপের উদ্দেশে। কিন্তু মেয়েটির অন্য জায়গায় বিয়ের কথা পাকা। মেয়ের বাপ কথা বল্লাতে রাজি নয়।
“এবার গল্পটিকে ট্রাজেডিও করতে পার, কমেডিও করতে পার। যদি ট্রাজেডি করতে চাও,লেখ, বিয়ের পরে মেয়েটির সঙ্গে আবার একদিন ছেলেটির দেখা। মেয়েটি ছেলেকে বলল, আমাদের যাকিছু কথা রইল মনে মনে। বাইরের মিলন আমাদের হল না কিন্তু মনের মিলন থেকে কেউ আমাদের বঞ্চিত করতে পারবে না।”
কবির এই প্লট অবলম্বন করিয়া আমি নাটক রচনা করিয়াছিলাম দুই-তিনবার অদলবদল না করিয়া কোন লেখা আমি প্রকাশ করি না। কবি জীবিত থাকিতে তাহাকে তাই নাটক দেখাইতে পারি নাই। ‘পল্লীবধূ’ নাম দিয়া নাটকটি কয়েক বৎসর পূর্বে প্রকাশিত হইয়াছে। ঢাকা বেতারে এই নাটক অভিনীত হইয়া শত শত শ্রোতার মনোরঞ্জন করিয়াছে। আজ যদি রবীন্দ্রনাথ বাঁচিয়া থাকিতেন, এই নাটক তাহাকে উপহার দিয়া মনে মনে কতই না আনন্দ পাইতাম।।
অবনীন্দ্রনাথের বাড়িতে মাঝে মাঝে নন্দলাল বসু আসিতেন গুরুর সঙ্গে দেখা করিতে। সেই উপলক্ষে শিল্পী নন্দলালের সঙ্গে আমার পরিচয়। নন্দলাল শুধুমাত্র তুলি দিয়া মনের কথা বলেন, গুরুর মত কলমের আগায় ভাষার আতসবাজী ফুটাইতে পারেন না। কিন্তু তার সঙ্গে আলাপ করিতে আমার খুব ভাল লাগত। আর্টের বিষয়ে ছবির বিষয়ে তিনি এত সুন্দর সুন্দর কথা বলিতেন যা লিখিয়া রাখিলে সাহিত্যের অপূর্ব সম্পদ হইত।
কয়েকটি কথা মনে আছে। এখানে লিখিয়া রাখিল। “গাছের এক এক সময়ে এক এক রূপ। সকাল সন্ধ্যা দুপুর রাত্রি কত ভাবেই গাছ রূপ-পরিবর্তন করছে। শান্তিনিকেতনে আমার ছাত্রেরা গভীর রাত্রিকালে জেগে উঠে গাছের এই রূপ-পরিবর্তন লক্ষ্য করে।”
সুদূর মাদ্রাজ হইতে আসিয়াছিল নন্দলালের এক ছাত্র। আর্ট ইস্কুলে পাঁচ-ছয় বৎসর ছবি আঁকা শিখিয়া বাড়ি ফিরিবার সময় দুঃখ করিয়া নন্দলালকে বলিল, “আমি চলেছি আমাদের পাড়াগাঁয়ে, সেখানে আমার আর্ট কেউ বুঝবে না। বাকি জীবনটা আমাকে নির্বাসনে কাটাতে হবে।” নন্দলাল ছাত্রকে আদর করিয়া কাছে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি গ্রামে গিয়ে দেখতে পাবে এক রাখাল-বালক হাতে ছুরি নিয়ে তার লাঠির উপরে ফুলের নক্সা করছে। তার গরু হয়তো তখন পরের ক্ষেতে ধান খাচ্ছে, এজন্য তাকে বকুনি শুনতে হবে। কিন্তু সেদিকে তার কোন খেয়াল নেই। সে একান্ত মনে তার লাঠিতে ফুল তুলছে। আরও দেখবে, কোন এক গাঁয়ের মেয়ে হয়ত কাঁথা সেলাই করছে কিম্বা রঙ-বেরঙের সুতো নিয়ে সিকা বুনছে। তার উনুনের উপর তরকারি পুড়ে যাচ্ছে, কিম্বা কোলের ছেলেটি মাটিতে পড়ে আছাড়িপিছাড়ি কান্না কাঁদছে। কোন দিকে তার খেয়াল নেই। সে সুতোর পর সুতো লাগিয়ে কাঁথার উপর নতুন নক্সা বুনট করছে। সেই রাখাল ছেলে সেই গ্রামের মেয়ে এরাই হবে তোমার সত্যিকার শিল্পীবন্ধু। এদের সঙ্গে যদি মিতালি করতে পার তবে তোমার গ্রাম্য জীবন একঘেয়ে হবে না। চাই কি, তাদের সৃজন-প্রণালী যদি তোমার ছবিতে প্রভাব বিস্তার করে, তুমি শিক্ষিত সমাজের শিল্পে নতুন কিছু দান করতে পারবে।”
খেলনা-পুতুলের বিষয়ে তিনি বলিতেন, “কৃষ্ণনগরের খেলনা পুতুল রিয়ালিটিক। এক অংশ ভেঙে গেলে সেগুলো দিয়ে আর খেলা করা যায় না। আমাদের গ্রামদেশী পুতুল আইডিয়ালিটিক, এক অংশ ভেঙে গেলেও তা দিয়ে খেলা করা যায়। এমনি বহু সুন্দর সুন্দর কথা শুনিতাম নন্দলালের কাছে। আজ নন্দলাল অসুস্থ হইয়া শান্তিনিকেতনে অবস্থান করিতেছেন। কোন ছাত্র যদি তার সঙ্গে তার শিল্পী-জীবনের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করিয়া তাহা লিপিবদ্ধ করেন, তবে উহা সমস্ত বাঙালীর সম্পদ হবে। নন্দলাল আমার ‘বালুচর’ পুস্তকের জন্য একখান। সুন্দর প্রচ্ছদপট আঁকিয়া দিয়াছিলেন। ‘রাখালী’র বর্তমান সংস্করণ নন্দলালের আঁকা একটি প্রচ্ছদপটে শোভা পাইতেছে।
সেবার নন্দলালের সঙ্গে শান্তিনিকেতন গেলাম। যে কয়দিন ছিলাম শিল্পীর পত্নী অতি যত্নের সঙ্গে আমার আহারাদির ব্যবস্থা করিলেন। পানিবাসে আমার থাকার ব্যবস্থা হইল। পান্থনিবাসের ঘরের ছাতের উপর নন্দলাল কতকগুলি মাছের ছবি আঁকিয়া রাখিয়াছেন। সেগুলির দিকে চাহিয়া পথিকের মনে জলের
শীতলতা আনিয়া দেয়। নন্দলাল গর্বের সঙ্গে বলিতেন, সাঁওতালের পথ দিয়া যাইতে যাইতে মাঝে মাঝে তাঁহার আঁকা ছবিগুলির দিকে চাহিয়া দেখে। এই ব্যাপারটি তার শিল্পী-জীবনের একটি বড় সার্থকতা বলিয়া তিনি মনে করিতেন।
পান্থনিবাসে আসিয়া দেখা হইল পাগলা নিশিকান্তের সঙ্গে। নিশিকান্ত ছবি আঁকে। সে ছবির সঙ্গে অন্য কারো ছবির মিল নাই। নিশিকান্ত কবিতা লেখে, সে কবিতার সঙ্গে কারো কবিতার মিল নাই। এমন অদ্ভুত ভাব-পাগল। অবনীন্দ্রনাথের বাড়ীতে আগেই তাহার সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল। এবার সে পরিচয় আরও নিবিড় হইল। নিশিকান্তের বন্ধু সান্ত্বনা গুহ। সুতরাং সে আমারও বন্ধু হইল। অনেক রাত পর্যন্ত তিন বন্ধুতে গল্পগুজব করিলাম। শেষরাত্রে শান্তিনিকেতনের বৈতালিকদল, ‘আমার বসন্ত যে এলো’ গানটি গাহিয়া সমস্ত আশ্রম পরিক্রমা করিতেছিল। সুমধুর কণ্ঠস্বর শুনিয়া ঘুম ভাঙিয়া গেল। যেন এক স্বপ্ন-জগতে জাগিয়া উঠিলাম। তখন ভোরের আলোকে চারিদিক পরিষ্কার হয় নাই। আলো-আঁধারী ভোরের বাতাসে পাখির সঙ্গে বৈতালিকদের গান আম্র শুরুর শাখায় শাখায় আনন্দের শিহরণ তুলিতেছিল। বসন্ত যে আসিয়াছে তাহা এখানে আসিয়াই বুঝিতে পারিলাম।