কবিকে সঙ্গে লইয়া যখন তমিজউদ্দিন সাহেবের বাসায় গিয়া উপস্থিত হইলাম, তমিজউদ্দিন সাহেব তাঁহার সমর্থক গুণগ্রাহীদের দ্বারা পরিবৃত হইয়া দরবার সাজাইয়া বসিয়াছিলেন। কবিকে দেখিয়া তাঁহারা সবাই আশ্চর্য হইয়া গেলেন। কবি যখন তাঁহার ভোটঅভিযানের কথা বলিলেন, তখন তমিজউদ্দিন সাহেবের একজন সভাসদ বলিয়া উঠিলেন, “তুমি কাফের। তোমাকে কোন মুসলমান ভোট দিবে না।”
তমিজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে আমাদের শত মতভেদ থাকিলেও তিনি বড়ই ভদ্রলোক। কবিকে এরূপ কথা বলায় তিনি বড়ই মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। কবি কিন্তু একটুও চটিলেন না। তিনি হাসিয়া বলিলেন, “আপনারা আমাকে কাফের বলছেন, এর চাইতে কঠিন কথাও আমাকে শুনতে হয়। আমার গায়ের চামড়া এত পুরু যে আপনাদের তীক্ষ্ণ কথার বাণ তা ভেদ করতে পারে না। তবে আমি বড়ই সুখী হব, আপনারা যদি আমার রচিত দু-একটি কবিতা শোনেন।”
সবাই তখন কবিকে ঘিরিয়া বসিলেন। কবি আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। কবি যখন তাহার “মহরম” কবিতাটি আবৃত্তি করিলেন, তখন যে ভদ্রলোক কবিকে কাফের বলিয়াছিলেন তারই চোখে সকলের আগে অশ্রুধারা দেখা দিল। কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন—যে কাজে আমরা আসিয়াছি, সে দিকে তাঁর দৃষ্টি নাই। আমি কবির কানে কানে বলিলাম, “এইবার আপনার ইলেকসনের কথা ওঁদের বলুন।”
কিন্তু কে কাহার কথা শোনে! কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। তখন আমি মরিয়া হইয়া সবাইকে শুনাইয়া বলিলাম, “আপনারা কবির কবিতা শুনছেন—এ অতি উত্তম কথা। কিন্তু কবি একটি বড় কাজে এখানে এসেছেন। আসন্ন ভোট-সংগ্রামে কবি আপনাদের সমর্থন আশা করেন। এই বিষয়ে কিছু আলোচনা করুন।”
তমিজউদ্দিন সাহেব চালাক লোক। কবিতা আবৃত্তি করিয়া কবি তাঁহার সমর্থক ও ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে কিঞ্চিৎ প্রভাব বিস্তার করিয়াছেন। তিনি যে কবিকে সমর্থন করিবেন না, এই আলোচনা তিনি তাঁহাদের সকলের সামনে করিলেন না। কবিকে তিনি আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গেলেন। পাঁচ-ছয় মিনিট পরে হাসিমুখেই তাহারা দুইজনে আসরে ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়া কবি আবার পূর্ববৎ কবিতা আবৃত্তি করিয়া চলিলেন। আমি ভাবিলাম, কেল্লা ফতে! কবির হাসিমুখ দেখিয়া এবং আবার আসিয়া তাহাকে কবিতা আবৃত্তি করিতে দেখিয়া ভাবিলাম, নিশ্চয়ই তমিজউদ্দিন সাহেবের দল কবিকে সমর্থন করিবে।
কবি আবৃত্তি করিয়াই চলিয়াছেন। বেলা দুইটা বাজিল। কবির সে দিকে হুশ নাই। কবির শ্রোতারাই এ বিষয়ে কবিকে সজাগ করিয়া দিলেন। কবি তাহার কাগজপত্র কুড়াইয়া লইয়া বিদায় হইলেন। তাদের মধ্য হইতে একটি লোকও বলিলেন না, এত বেলায় আপনি কোথায় যাইবেন, আমাদের এখান হইতে খাইয়া যান। আমার নিজের জেলা ফরিদপুরের এই কলঙ্ক-কথা বলিতে লজ্জায় আমার মাথা নত হইয়া পড়িতেছে। কিন্তু এ কথা না বলিলে, সেই যুগে আমাদের সমাজ এত বড় একজন কবিকে কি ভাবে অবহেলা করিতেন, তাহা জানা যাইবে না। অথচ এদেরই দেখিয়াছি, আলেম-সমাজের প্রতি কী গভীর শ্রদ্ধা! কত গরীব ছাত্রকে তমিজউদ্দিন সাহেব অন্নদান করিয়াছেন!
দুইটার সময় তমিজউদ্দিন সাহেবের বাড়ি হইতে বাহির হইয়া ভাবিলাম, এখন কোথায় যাই। আমার বাড়ি শহর হইতে দুই মাইলের পথ; হাঁটিয়া যাইতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগিবে। পৌঁছিতে তিনটা বাজিবে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া আজ আর শহরে ফিরিয়া কাজকর্ম করা যাইবে না। স্থির করিলাম, বাজারে কোন হোটলে খাওয়া সারিয়া অন্যান্য স্থানে ভোট-সংগ্রহের কাজে মনোনিবেশ করিব।
পথে আসিতে আসিতে কবিকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তমিজউদ্দিন সাহেবের দল আমাদের সমর্থন করিবে। এবার তবে কেল্লা ফতে!”
কবি উত্তর করিলেন, “না রে, ওঁরা বাইরে ডেকে নিয়ে আমাকে আগেই খুলে বলে দিয়েছেন, আমাকে সমর্থন করবেন না। ওঁরা সমর্থন করবেন বরিশালের জমিদার ইসমাইল সাহেবকে।”
তখন রাগে দুঃখে কাঁদিতে ইচ্ছা হইতেছিল। রাগ করিয়াই কবিকে বলািম, “আচ্ছা কবিভাই, এই যদি আপনি জানলেন, তবে ওঁদের কবিতা শুনিয়ে সারাটা দিন নষ্ট করলেন কেন?”
কবি হাসিয়া বলিলেন, “ওরা শুনতে চাইলে, শুনিয়ে দিলুম।”
এ কথার কী আর উত্তর দিব? কবিকে লইয়া হোটলের সন্ধানে বাহির হইলাম। তখনকার দিনে ফরিদপুর শহরে ভাল হোটেল ছিল না। যে হোটেলে যাই, দেখি মাছি ভনভন করিতেছে। ময়লা বিছানা-বালিশ হইতে নোংরা গন্ধ বাহির হইতেছে। তারই মধ্যে অপেক্ষাকৃত একটি পরিষ্কার হোটেল বাছিয়া লইয়া কোন রকমে ভোজনপর্ব সমাধা করিলাম।
শ্রেষ্ঠ কবিকে আমার দেশ এই সম্মান জানাইল। এই জন্যই বুঝি আধুনিক মুসলিম-সমাজে বড় লেখক বা বড় কবির আগমন হয় নাই। মিশর, তুরস্ক, আরব—কোন দেশেই আন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখকের উদয় হইতেছে না। অথচ ইসলামের আবির্ভাবের প্রারম্ভে আমাদের সমাজে কত বিশ্ববরেণ্য মহাকবির আবির্ভাব ঘটিয়াছিল। হাফিজ, রুমী, সানী, ওমর খৈয়াম—এদের লেখা পড়িয়া জগৎ মোহিত। কিন্তু আজ কি দেখিতেছি? সমস্ত মুসলিম-জগতে কোথা হইতেও প্রতিভার উদয় হইতেছে না। প্রতিভাকে বড় ও পুষ্ট করিয়া তুলিবার মত মানসিকতা আমাদের সমাজ-জীবন হইতে নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বনে জঙ্গলে আগাহার অন্তরালে বহু ফুল ফুটিয়া থাকে। কে তাহাদের সন্ধান রাখে? ফুলের বাগান করিতে হইলে উপযুক্ত মালির প্রয়োজন; ফুলগাছের তদ্বির-তালাসী করিবার প্রয়োজন। গাছের গোড়া হইতে আগাছা নষ্ট করিয়া দিতে হয়; গোড়ায় পানি ঢালিতে হয়। তবেই ফুলের গাছে ফুল ফোটে, সেই ফুলের গন্ধে দুনিয়া মাতোয়ারা হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে যদি ভুলেও দু-একটা ফুলগাছ জন্মে, আমরা গোড়ায় পানি ঢালা তো দূরের কথা, কুঠার লইয়া তাহাকে আঘাত করিতে প্রবৃত্ত হই। নজরুল-জীননের সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, তারা সকলেই এ কথার সাক্ষ্যদান করিবেন। নজরুলের কবিজীবনের আবির্ভাবের সময় আমাদের সমাজ যে কুৎসিত ভাষায় কবিকে আক্রমণ করিয়াছেন, যে ভাবে তাঁহার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছেন, তাহার কণ্টক-ক্ষতগুলি মহাকাল কবির কাব্যের সঙ্গে বহন করিয়া চলিবে। অনাগত যুগের কাব্য-রসগ্রাহীদের কাছে আমরা এইজন্য হেয় হইয়া থাকিব।