পরদিন পূর্ব আকাশে অপূর্বদ্যুতি জবাকুসুমের রঙে রঙিন হইয়া সূর্যোদয় হইল। আমরা কবিকে লইয়া বিদায় হইলাম। দুই পাশের শস্যক্ষেত্রে সবুজ নতুন পত্র-মঞ্জরী দেখা দিয়াছে। রাতের শিশির-স্নাত পত্রগুলি বিহানবেলার রৌদ্রে ঝলমল করিয়া কবিকে অভ্যর্থনা করিতেছিল। কবি ‘বিষের বাঁশী’ আর ‘ভাঙ্গার গান’ সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন। এই বই দুইখানি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হইয়াছিল। কবির শিষ্যদল কনফারেন্সের অধিবেশনে এই বই বিক্রয় করিবার জন্য, আনিয়াছিলেন। বইগুলি আমার বাড়িতে রাখিয়া কবি ফরিদপুর শহরে কনফারেন্সের ময়দানে গিয়া উপস্থিত হইলেন। থাকিবার জন্য তাঁহাকে একটি তাঁবু দেওয়া হইল। আমি হইলাম কবির খাস-ভলান্টিয়ার।
এই কনফারেন্সে বাংলাদেশের বহু নেতা আসিয়াছিলেন। তখন কবি ভাল বক্তৃতা করিতে শেখেন নাই। সভায় কবি যাহা বলিলেন, তাহা নিতান্ত মামুলী ধরনের। কিন্তু কবি যখন গান ধরিলেন, সেই গানের কথায় সমস্ত সভা উদ্বেলিত হইয়া উঠিল। গান ছাড়িলে সভার লোকে আরও গান শুনিবার জন্য চিৎকার করিয়া উঠিতেছিল। কবির কণ্ঠস্বর যে খুব সুন্দর ছিল তাহা নয়, কিন্তু গান গাহিবার সময় গানের কথা-বস্তুকে তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়া জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিলেন। কবি যখন ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া অথবা ‘শিকল পরা ছল মোদের এই শিকল পরা ছল’ প্রভৃতি গান গাহিতেছিলেন, তখন সভায় যে অপূর্ব ভাবরসের উদয় হইতেছিল, তাহা ভাষায় বলিবার নয়। জেল হইতে সদ্য খালাস পাইয়া বহু দেশকর্মী সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। দেশকে ভালবাসিয়া শতসহস্র কমী আপন অঙ্গে লাঞ্ছনার তিলক-চিহ্ন ধারণ করিয়াছিলেন। নজরুলের গান যেন তাহাদের দুঃখ-লাঞ্ছনার আশাআকাক্ষার জীবন্ত প্রতীক।
একদিন মহাত্মা গান্ধীর সামনে নজরুল তাঁর ঘোর ঘোর ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর’—গানটি গাহিলেন। গান্ধীজী গান শুনিয়া হাসিয়া কুটিকুটি। কনফারেন্স শেষ হইলে কবি আবার আমার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কবি স্থির করিলেন, তিনি এখানে বসিয়া বাবুচর’ নামে একখানা বই লিখিবেন। কিছুদিন কবির সঙ্গে কাটাইতে পারিব, এই আশায় মন পুলকিত হইয়া উঠিল।
কিন্তু অল্পদিন পরে পাবনা হইতে এক ভদ্রলোক আসিয়া কবিকে চিলের মত ছোঁ। মারিয়া লইয়া গেলেন। যাইবার সময় কবি কথা দিয়া গেলেন, ফিরিবার সময় আবার আমার এখানে আসিবেন।
কবির বাজেয়াপ্ত বইগুলির কিছু আমার কাছে রাখিয়া গেলেন। কিন্তু কবি আর ফিরিয়া আসিলেন না। বহুদিন পরে কবি চিঠি লিখিলেন, বইগুলির কিছু যদি বিক্রয় হইয়া থাকে তবে আমি যেন সত্বর তাহাকে টাকাটা পাঠাইয়া দিই। কবির অসুখ। অর্থের খুব টানাটানি। কিন্তু বাজেয়াপ্ত বই কেহ কিনিতে চাহে না। পুলিসে ধরা পড়িবার ভয় আছে। কিছুই বিক্রয় করিতে পারি নাই। আমি তখন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে গ্রাম্য-গান সংগ্রহের জন্য মাসে সত্তর টাকা করিয়া স্কলারশিপ পাইতাম। সেই টাকা হইতে কিঞ্চিৎ অর্থ কবির নিকট মনিঅর্ডার করিয়া পাঠাইলাম।
একবার কলিকাতা গিয়া কবির সঙ্গে দেখা করিতে তাঁহার বাসায় যাই। তখন বিবাহ করিয়া সদ্য সংসার পাতিয়াছেন। হাস্যরসিক নলিনী সরকার মহাশয়ের বাসায় তিনি থাকেন। কবি আমাকে শয়ন-গৃহে ডাকিয়া পাঠাইলেন। নতুন ভাবীর সঙ্গে কবি লুডো খেলিতেছিলেন। ভাবীর সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিয়া কবি আমাকেও খেলিতে আহ্বান করিলেন। আমি অনেকক্ষণ তাহাদের সঙ্গে খেলিলাম। ভাবীর সেই রাঙা-টুকটুকে মুখের হাসিটি আজও মনে আছে। তখন কবির আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। কবিপ্রিয়া কিন্তু আমাকে না খাইয়া আসিতে দিলেন না। আমি কবির কোন রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় নই। তবু কবি আমাকে আপন ভাইএর মত তাঁর গৃহের একজন করিয়া লইলেন। এর পর যখনই কবিগৃহে গমন করিয়াছি, কবি-পত্নীর ব্যবহারে সঁহাদের গৃহখানি আমার আপন বলিয়া মনে হইয়াছে।
আমি তখন মেছুয়াবাজারে ওয়াই, এম. সি এ হোস্টেলে থাকিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম. এ. পড়ি। আমাদের হোস্টেলে মাঝে মাঝে নানা রকম উৎসব-অনুষ্ঠান হইত। তাহাতে হোস্টেলের ছাত্রেরা নিজেদের আত্মীয়া মহিলাদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিতেন। কলিকাতায় আমার কোন নিকট আত্মীয়া নাই, আমি আর কাহাকে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিব! একদিন সেই কথা ভাবীকে বলিলাম। ভাবী অতি সহজেই আমাদের হোস্টেলে আসিতে রাজী হইলেন। ভাবীর মা খালাআম্মাও সঙ্গে আসিলেন। উৎসব-সভায় তাঁহারা আসিয়া যখন উপবেশন করিলেন, তখন ভাবীকে দেখিবার জন্য ছাত্রমহলে সাড়া পড়িয়া গেল। আমার মনে হয়, কবি-গৃহিণীর জীবনে বাহিরের কোন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া এই প্রথম।
ভাবীর মতন এমন সর্বংসহা মেয়ে বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। কবির ছন্নছাড়া নোঙরহীন জীবন। এই জীবনের অন্তঃপুরে স্নেহ-মমতায় মধুর হইয়া চিরকাল তিনি কবির কাব্যসাধনাকে জয়যুক্ত করিয়াছিলেন। কোন সময় তাঁহাকে কবির সম্পর্কে কোন অভিযোগ করিতে দেখি নাই। প্রথম জীবনে কবি ভাবীকে বহু সুন্দর সুন্দর পত্র লিখিয়াছেন। ভাবী সেই পত্রগুলি যখের ধনের মত রক্ষা করিতেন। একদিন ভাবীকে বলিলাম, “ভাবী, আমি আপনার ভাই। যদি ভরসা দেন তো একটা অনুরোধ আপনাকে করব?
ভাবী হাসিয়া উত্তর করিলেন, “কি অনুরোধ, বল তত ভাই।”
আমি বলিলাম, “কবিভাই আপনাকে যেসব চিঠি লিখেছেন, তার দু-একখানা যদি আপনি আমাকে দেখান।