এই নাটক অভিনয়ের সাত-আট দিন আগে কবি দলবল লইয়া শান্তিনিকেতন হইতে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আগমন করিলেন। প্রতিদিন মহাসমারোহে নাটকের মহড়া চলিল। বন্ধু মোহনলালের সঙ্গে লুকাইয়া আমি এই নাটকের মহড়া দেখিতে যাইতাম। তাহাতে লক্ষ্য করিতাম’ নাটকটি অভিনয়ের উপযোগী করিতে কবি বিভিন্ন ভূমিকাগুলিকে কেবলই বদলাইয়া চলিয়াছেন। কবির নাটকে যাঁহারা অভিনয় করিতেন তাহাদিগকে বড়ই বিপদে পড়িতে হইত। যে পর্যন্ত অভিনেতা মঞ্চে গিয়া না দাঁড়াইতেন, সে পর্যন্ত ভুমিকার পরিবর্তন হইতে থাকিত। মোহনলালের নিকট শুনিয়াছি, কোন অভিনেত্রী তাহার নির্দিষ্ট ভূমিকা বলিতে মঞ্চে প্রবেশ করিতেছেন, এমন সময় কবি তাহাকে ডাকিয়া বলিয়া দিলেন, “দেখ, এইখানটিতে এই কথাটি না বলে ওই কথাটি বলবে।”
‘তপতী’ নাটক পরে শিশিরকুমার ভাদুড়ী মহাশয় সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনয় করেন। এই অভিনয়ের চার-পাঁচ দিন আগে কবি শিশির কুমারকে টেলিগ্রামে শান্তিনিকেতনে ডাকাইয়া লইয়া গিয়া নাটকের কয়েকটি অংশ বদলাইয়া দিলেন। কবির সৃজনীশক্তি কিছুতেই পরিতৃপ্ত হইতে জানিত না। বিধাতা যেমন তাহারা অপুর্ব-সৃষ্টিকাব্য ধরণীর উপর আলো ছড়াছয়া আঁধার ছড়াইয়া নানা ঋতুর বর্ণসুষমা মাখাইয়া উহাকে নব নব রূপে রূপায়িত করেন, তেমনি কবি তাঁর রচিত কাব্য উপন্যাস ও নাটকগুলিকে বারম্বার নানাভাবে নানা পরিবর্তনে উৎকর্ষিত করিয়া আমাদের জন্য রাখিয়া গিয়াছেন। ‘রাজারানী’ নাটকের ‘তপতী’-সংস্করণক বির এই সৃষ্টিধমীমনের অসন্তুষ্টির অবদান।
রবীন্দ্র-জয়ন্তীর সময় ছাত্র-ছাত্রীদের তরফ হইতে রবীন্দ্রনাথের ‘নটীর পূজা’ নাটকের অভিনয় হয়। শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা অনুষ্ঠান সাফল্যমণ্ডিত করিয়া তোলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ প্রম্পট করিয়াছিলেন। শেষ দৃশ্যে যেখানে নটীর মৃত্যুর পর ড্রপসিন পড়ার কথা –অর্ধেক ড্রপসিন পড়িয়া গিয়াছে, হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ গায়ে একটা মোটা কম্বল জড়াইয়া মঞ্চে আসিয়া নটীর মৃতদেহের উপর দুই হাত শূন্যে তুলিয়া ‘ওঁ শান্তি ওঁ শান্তি’ এই মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া গেলেন। তখন হইতে নটীর পূজা শেষ দৃশ্যে এই পাঠটি প্রবর্তিত হইয়া আসিতেছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার খাতা দেখিয়াছি। তাহাতে এত পরিবর্তন ও এত কাটাকুটি যে দেখিয়া অবাক হইতে হয়। রবীন্দ্রনাথের সৃজনীশক্তি কিছুতেই যেন তৃপ্ত হইতে জানিত না। আজীবন তিনি গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, তাহার প্রত্যেকখানিতে তাহার মনের একান্ত যত্নের ছাপ লাগিয়া রহিয়াছে। লিখিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনি অপরকে দিয়া নকল করান নাই। যতবার নকল করিতে হয় নিজেই করিয়াছেন এবং প্রত্যেক বারেই সেই রচনার ভিতর তাঁহার সূজনী-শক্তির অপূর্ব কারুকার্য রাখিয়া গিয়াছেন।
তপতী’র পরে নাটক রচনার নেশা রবীন্দ্রনাথকে পাইয়া বসিয়াছিল। তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে গিয়া আমি পাড়াগাঁয়ের লোকনাট্য আসমান সিংহের পালার উল্লেখ করিলাম। কবি আমাকে বলিলেন, “তুমি লেখ না একটা গ্রাম্য নাটক।” আমি বলিলাম, “নাটক আমি একটা লিখেছি। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ পড়ে বললেন, নাটক লেখার শক্তি তোমার নেই।” কবি জোরের সঙ্গে বলিলেন, “অবন নাটকের কি বোঝে? তুমি লেখ একটা নাটক তোমাদের গ্রাম দেশের কাহিনী নিয়ে। আমি শান্তিনিকেতনের ছেলে মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করাব।”
আমি বলিলাম, “একটা প্লট যদি দেন তবে আর একবার চেষ্টা করে দেখি।”
কবি বলিলেন, “আজ নয়। কাল সকালে এসো।”
পরদিন কবির সামনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। একথা-সেকথার পরে আমার নাটকের প্লট দেওয়ার কথা কবিকে মনে করাইয়া দিলাম।
কবি হাসিয়া বলিলেন, “তুমি দেখছি, ছাড়বার পাত্র নও। চোরের মন বোচকার দিকে।” নিকটে আরও দু-একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তাঁহারা হাসিয়া উঠিলেন। কবি প্লট বলিতে লাগিলেন—
“ধর, তোমাদের পাড়াগাঁয়ের মুসলমান মোড়লের ছেলে কলকাতায় এম, এ, পড়তে এসেছে। বহু বৎসর বাড়ি যায় না। এম, এ, পাশ করে সে বাড়ি এসেছে। বাবা মা সবাই তাদের পুরনো গ্রাম্য রীতিনীতিতে তাকে আদর যত্ন করলেন। কিন্তু ছেলের এসব পছন্দ হয় না। সে বলে, তোমরা যদি আমাকে এমন করে আদরঅভ্যর্থনা না করতে তবেই ভাল হত। আদর করেই তোমরা আমাকে অপমান করছ।
“ছেলেটির সঙ্গে গ্রামের অন্য একজন মোড়লের মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। বিয়ের কথা বাপ বলতেই ছেলে রেগে অস্থির। অমুকের মেয়ে অমুক—সেই ছোট্ট এতটুকু মেয়ে তাকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। গ্রাম্য চাষী হবে তার শশুর!
“মেয়েটির তখন অন্যত্র বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেল। পাকাদেখার দিন ছেলেটা মেয়ের বাড়িতে কি উপলক্ষে গিয়ে তাকে দেখে এলো। ছেলেবেলায় যাকে সে একরত্তি এতটুকু দেখেছিল আজ সে পরিপূর্ণ যুবতী। ছেলের মনে হল, এমন রূপ যেন সে আর কোথাও দেখেনি।
“বাপ ছেলেকে বড়ই ভালবাসেন। বাপ দেখলেন কিছুতেই ছেলের মন টিকছে না, তখন তিনি ছেলেকে গিয়ে বললেন, “দেখ, অনেক ভেবে দেখলাম, দেশে থাকা তোর পক্ষে মুশকিল। তুই কলকাতায় চলে যা। এখানকার জলবায়ু ভাল না। কখন অসুখ করবে কে জানে। মাসে মাসে তোর যা টাকা লাগে, আমি পাঠিয়ে দেব। তুই কলকাতায় চলে যা।।
“তখন ছেলে এক মস্ত বক্তৃতা দিল। কে বলে, এ গ্রাম আমার ভাল লাগে না? ছেলেবেলা থেকে আমি এখানে মানুষ। এ গাঁয়ের গাছপালা লতাপাতা সব আমার বালককালের খেলার সঙ্গী।