প্রথম পরিচয়ের উত্তেজনায় সেদিন কবির সঙ্গে আর কি কি আলাপ হইয়াছিল, আজ ভাল করিয়া মনে নাই।
ইহার দুই-তিন দিন পরে দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের মধ্যম ছেলে অধ্যাপক অরুণ সেন আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “তুমি কবিকে বই দিয়ে এসেছিলে। আজ দুপুরে আমাদের সামনে কবি অনেকক্ষণ ধরে তোমার কবিতার প্রশংসা করলেন। এমন উচ্ছ্বসিতভাবে কারো প্রশংসা করতে কবিকে কমই দেখা যায়। কবি অভিপ্রায় প্রকাশ করেছেন, তিনি তোমাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে যাবেন।”
পরদিন সকালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসিয়া আমি কবির সঙ্গে দেখা করিলাম। কবি আমার বই দুইখানির প্রশংসা করিলেন। বলিলেন, “আমি শান্তিনিকেতনে গিয়েই তোমার বই দু’খানার উপর বিস্তৃত সমালোচনা লিখে পাঠাব। তুমি শান্তিনিকেতনে এসে থাক।
ওখানে আমি তোমার একটা বন্দোবস্ত করে দেব।”
আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম “এখানে আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম, এ, পড়ছি। শান্তিনিকেতনে গেলে তো পড়া হবে না।”
কবি বলিলেন, “ওখান থেকে ইচ্ছে করলে তুমি প্রাইভেটে এম, এ, পরীক্ষা দিতে পারবে। আমি সে বন্দোবস্ত করে দেব।”
আমি উত্তরে বলিলাম “ভাল করে ভেবে দেখে আমি আপনাকে পরে জানাব।”
কলিকাতায় আমার সব চাইতে আপনার জন দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে পরামর্শ করিলাম। তিনি আমাকে কলিকাতা ছাড়িয়া শান্তিনিকেতনে যাইতে নিষেধ করিলেন। তিনি বলিলেন, “কবি যদি এত বৃদ্ধ না হতেন তবে আমি ওখানে যেতে বলতাম। কিন্তু কবি কতকাল বেঁচে থাকবেন, বলা যায় না। এখান থেকে এম, এ, পাশ করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা কর। ওখানকার আশ্রয় পাওয়ার সৌভাগ্য দীর্ঘ কাল তোমার না-ও হতে পারে।”
আমার শান্তিনিকেতন যাওয়া হইল না। ইহার পর কবি আরও বার বৎসর বাঁচিয়াছিলেন। আজ অনুতাপ হইতেছে, এই সুদীর্ঘ বার বৎসর যদি কবির সান্নিধ্য লাভ করিতে পারিতাম, তবে জীবনে কত কি শিখিতে পারিতাম।
কবি শান্তিনিকেতনে চলিয়া গেলেন। প্রায়-দুই মাস চলিয়া গেল। কবি আমার বই-এর সমালোচনা পাঠাইলেন না। কিন্তু কি ভাষাতেই বা কবিকে তাগিদ দিয়া পত্র লিখিব। বহু চেষ্টা করিয়াও কবিকে লিখিবার মত ভাষা খুঁজিয়া পাই না। মোহনলালকে দিয়া কবিকে পত্র পাঠাইলাম। তখন কবি শান্তিনিকেতনে কি-একটা অভিনয় লইয়া ব্যস্ত। কবি একটা ছোট্ট চিঠিতে মোহনলালকে লিখিয়া পাঠাইলেন, “জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।”
কবির এই কথাগুলি বই-এর বিজ্ঞাপনে ছাপাইয়া সেই সময় মনে মনে খুবই বাহাদুরী অনুভব করিয়াছিলাম। নক্সীকাঁথার মাঠ ছাপা হইলে বাংলা দেশের বহু সাহিত্যিক ইহার প্রশংসা করিয়াছিলেন। যাঁহার বিরুদ্ধ সমালোচনা করিতে প্রস্তুত হইতে ছিলেন, রবীন্দ্রনাথের এই প্রসংসার পরে তাঁহারা আর সে বিষয়ে সাহসী হইলেন না। সাপ্তাহিক সম্মেলনীতে একজন প্রবীণ সাহিত্যিক নক্সীকাঁথার মাঠ’-এর সমালোচনার মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রতি কিছু কটাক্ষপাত করিয়াছিলেন, কিন্তু বইখানি যে খারাপ এ কথা বলিতে সাহস পান নাই।
ইহার পরে রবীন্দ্রনাথ যখনই কলিকাতা আসিয়াছেন, অবসর পাইলেই আমি গিয়া দেখা করিয়াছি। আমাকে দেখিলে কবি তাঁর বিগত কালের পদ্মাচরের জীবন লইয়া আলোচনা করিতেন।
তখন আমি বালুচর’ বইয়ের কবিতাগুলি লিখিতেছি। ইহার অধিকাংশ কবিতাই ত্রিপদী ছন্দে লিখিত। মাসিকপত্রে ইহার অধিকাংশ কবিতা ছাপা হয়। সমালোচকেরা বলিতে লাগিলেন, “তোমার কবিতা একঘেয়ে হইয়া যাইতেছে। ছন্দ পরিবর্তন কর।”
একদিন কবিকে এই কথা বলিলাম। কবি বলিলেন, “ওসব বাজে লোকের কথা শুনো না। যে ছন্দ সহজে এসে তোমার লেখায় ধরা দেয়, তাই ব্যবহার কর। ইচ্ছে করে নানা ছন্দ ব্যবহার করলে তোমার লেখা হবে তোতাপাখির বোলের মত। তাতে কোন প্রাণের স্পর্শ থাকবে না।”
‘বালুচর’ বইখানা ছাপা হইলে কবিকে একখানি পাঠাইয়া দিলাম। সঙ্গে পত্র লিখিয়া অনুরোধ করিলাম, পড়িয়া আপনার কেমন লাগে অনুগ্রহ করিয়া লিখিয়া জানাইবেন। কবি এ পত্রের কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি কলিকাতা আসিলে দেখা করিলাম। কবি বলিলেন, “তোমার বালুচর’ পড়তে গিয়ে বড়ই ঠকেছি হে। ‘বালুচর’ বলতে তোমাদের দেশের সুদূর পদ্মাতীরের চরগুলির সুন্দর কবিত্বপূর্ণ বর্ণনা আশা করেছিলাম। কেমন চখাচখি উড়ে বেড়ায়, কাশফুলের গুচ্ছগুলি বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু কতকগুলি প্রেমের কবিতা দিয়ে তুমি বইখানাকে ভরে তুলেছ। পত্রে এ কথা লিখলে পাছে রূঢ় শোনায় সে জন্য এ বিষয়ে কিছু লিখি নি। মুখেই বললাম।”
ইহার পরে রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলা কবিতার সংকলন বাহির করেন, তখন এই বালুচর’ বই হইতেই ‘উড়ানীর চর’ নামক কবিতাটি চয়ন করিয়াছিলেন।
‘রাজারানী, নাটকখানি নূতন করিয়া লিখিয়া রবীন্দ্রনাথ ইহার ‘তপতী’ নামকরণ করিলেন। একদিন সাহিত্যিকদের ডাকিয়া তাহা পড়িয়া শোনাইলেন। সেই সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। একই অধিবেশনে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরিয়া কবি সামনে নাটকখানা পড়িয়া গেলেন। বিভিন্ন চরিত্রের মুখে বিভিন্ন সংলাপগুলি কবির কণ্ঠে যেন জীবন্ত হইয়া উঠিতেছিল। এই নাটক মহাসমারোহে কবি কলিকাতায় অভিনয় করিলেন। কবি রাজার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন। সত্তর বৎসর বয়সের বৃদ্ধ কি করিয়া প্রেমের অভিনয় করিবেন, তাঁহার সাদা দাড়িরই বা কি হইবে, অভিনয়ের পূর্বে এই সব ভাবিয়া কিছুই কূলকিনারা পাইলাম না। কিন্তু অভিনয়ের সময় দেখা গেল, দাড়িতে কালো রঙ মাখাইয়া মুখের দুই পাশে গালপাট্টা তুলিয়া দিয়া কবি এক তরুণ যুবকের বেশে মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইলেন। তপতী’ নাটকে রাজার ব্যর্থ প্রেমের সেই মর্মান্তিক হাহাকার কবির কণ্ঠমাধুর্যে আর আন্তরিক অভিনয়নৈপুণ্যে মঞ্চের উপর জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এই নাটকে রাজার ভূমিকাটি বড়ই ঘোরালো। নাটকের সবগুলি চরিত্র রাজার বিপক্ষে। সেই সঙ্গে সাধারণ দর্শক-শ্রোতার মনও বাহির হইতে দেখিতে গেলে রাজার উপর বিতৃষ্ণ। রাজা যে রানীর ভালবাসা পাইল না, তারই জন্য যে রাজার সব কাজ নিয়ন্ত্রিত হইতেছিল, একথা সাধারণ দর্শক শ্রোতা সহজে বুঝিতে পারে না। হয়ত সেইজন্য ইহা বাংলার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে বেশীদিন টিকিল না। কিন্তু যাঁহারা গভীরভাবে এই নাটকটি আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহারা লক্ষ্য করিবেন, রাজার ব্যর্থ জীবনের হাহাকারের মধ্যে নাটকলেখকের দরদী অন্তর ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। এই ব্যাপারটি কবির অভিনয়ে জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছিল।