ইহার পরে কি করিয়া কবির ভ্রাতুষ্পুত্র অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে আমার পরিচয় হইল, তাহা পরে বলিব। আমি এম. এ. পড়িতে কলিকাতা আসিয়া ওয়াই, এম,সি এ হোস্টেলে আশ্রয় লইলাম। আমার রাখালী’ আর ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ বই দুইখানি ইহার বহু পূর্বেই প্রকাশিত হইয়াছে। কিছু কিছু কবিখ্যাতিও লাভ করিয়াছি। মাঝে মাঝে আমি অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে জোড়াসাঁকো যাই। এই উপলক্ষে ঠাকুর পরিবারের প্রায় সকলের সঙ্গেই আমার পরিচয় হইয়াছে। অবনীন্দ্রনাথের পাশের বাড়ি রবীন্দ্রনাথের। তিনি এখানে আসিয়া মাঝে মাঝে অবস্থান করেন। শান্তিনিকেতন হইতে গানের দল আসে। তাঁহাদের গানে অভিনয়ে সমস্ত কলিকাতা সরগরম হইয়া উঠে। আমার জানা-অজানা কতলোক আসিয়া কবির সঙ্গে দেখা করিয়া যায়। আমি কিন্তু একদিনও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করি না। আমার কবিতার বই দুইখানি বহু অখ্যাত বিখ্যাত সাহিত্যিককে উপহার দিয়াছি। মতামত জানিবার জন্য কতজনের দ্বারস্থ হইয়াছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠাই নাই।
তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথ বাংলা দেশের তরুণ সাহিত্যিকদের সমালোচনা করিয়া একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন। তাহাদের পক্ষ লইয়া শরৎচন্দ্র ইহার উত্তর দিয়াছিলেন। নজরুল হইতে আরম্ভ করিয়া বহু সাহিত্যিক নানা প্রবন্ধ লিখিয়া নিজেদের সদম্ভ আবির্ভাব ঘঘাষণা করিয়াছিলেন। বন্ধুবর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত কবিতা করিয়া লিখিলেন, সামনে যদি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পথ রুধিয়া দাঁড়ান তবু আমরা আগাইয়া যাইব। এই আন্দোলনের মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ শৈলজানন্দ প্রভৃতি কয়েকজন লেখককে প্রতিভাবান বলিয়া স্বীকৃতি দান করিলেন।
ইহার কিছুদিন পরে দিলীপকুমার, বুদ্ধদেব বসু রচিত কয়েকটি কবিতা কাঁচি-কাটা করিয়া রবীন্দ্রনাথকে পাঠাইলেন। রবীন্দ্রনাথ সেগুলির প্রশংসা করিলেন। আমি যদিও কল্লোল-দলের একজন, আমার লেখা লইয়া কেহই উচ্চবাচ্য করিলেন না। মনে অভিমান ছিল, আমার সাহিত্যের যদি কোন মূল্য থাকে তবে রবীন্দ্রনাথ একদিন ডাকিয়া আমাকে আদর করিবেন। ইতিমধ্যেই আমি রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুস্পুত্র অবনীন্দ্রনাথের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইয়াছি। রবীন্দ্রনাথের সামনে উপস্থিত হওয়া এখন আমার পক্ষে সব চাইতে সহজ, তবু ইচ্ছা করিয়াই ভঁহার সামনে উপযাচক হইয়া উপস্থিত হই নাই। কিন্তু আড়াল হইতে যতদূর সম্ভব তাহার খবর লইতেছি।
সেবার রবীন্দ্রনাথের খুব অসুখ হইল। সারা দেশ কবিব জন্য উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিল। শঙ্কাকুল দেশবাসী অতি আগ্রহের সহিত প্রতিদিন খবরের কাগজে কবির স্বাস্থ্যের খবর লক্ষ্য করিতে লাগিল। জাতির সৌভাগ্য, কবি রোগমুক্ত হইলেন। আরোগ্য লাভ করিয়া কবি কলিকাতা ফিরিয়া আসিলেন। সেটা বোধ হয় ১৯৩০ সন।
তখন আমার মনে হইল, বয়োবৃদ্ধ এই কবির সম্পর্কে অভিমান করিয়া দূরে থাকিলে জীবনে হয়তো তাঁহার সঙ্গে পরিচয় হইবে না। ক্ষণকালের অতিথি কখন যে ওপারের ডাক পাইয়া আমাদের এই পৃথিবী ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন তাহা কেহ জানে না।
অবনীন্দ্রনাথের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বন্ধু। দুই জনে অনেক জল্পনা-কল্পনা করিয়া একদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিতে রওনা হইলাম।
অবনীন্দ্রনাথের বাড়ি হইতে রবীন্দ্রনাথের ঘর তিন মিনিটের পথও নয়। এই এতটুকু পথ অতিক্রম করিতে মনে হইল যেন কত দূরের পথ যাইতেছি। আমার বুক অতি-আনন্দে দুরুদুরু করিতেছিল। ঘরের সামনে আসিয়া আমাকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া মোহনলাল ভিতরে প্রবেশ করিল। আমি দরজার সামনে দাঁড়াইয়া কত কথা ভাবিতে লাগিলাম। আমি যেন কোন অতীত যুগের তীর্থযাত্রী। জীবনের কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করিয়া আজ আমার চির-বাঞ্ছিত মহামানবের মন্দিরপ্রান্তে আগমন করিয়াছি। ছবির উপরে ছবি মনে ভাসিয়া আসিতেছিল। এতদিন এই কবির বিষয়ে যাহা ভাবিয়াছি, যাহা পড়িয়াছি, যাহা শুনিয়াছি সব যেন আমার মনে জীবন্ত হইয়া কথা কহিতেছিল। অনেকক্ষণ পরে মোহনলাল আসিয়া আমাকে ভিতরে লইয়া গেল। স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় আমি যেন কোন কল্পনার জগতে প্রবেশ করিলাম। সুন্দর কয়েকখানি ছবি দেওয়ালে টাঙানো। এখানে সেখানে সুন্দর সুপরিকল্পিত চৌকোণা আসন। তাহার উপরে নানা রঙের ডােরাকাটা বস্ত্র-আবরণ। সেগুলি বসিবার জন্য না দেখিয়া চোখের তৃপ্তি লাভের জন্য কে বলিয়া দিবে! এ যেন বৈদিক যুগের কোন ঋষির আশ্রমে আসিয়াছি।
তখন বর্ষাকাল। কদমফুলের গুচ্ছ গুচ্ছ তোড়া নানা রকমের ফুলদানীতে সাজান। আধ-ফোটা মোটা মোটা কেয়াফুলের গুচ্ছ কবির সামনে দুইটি ফুলদানী হইতে গন্ধ ছড়াইতেছিল। বেলীফুলের দু-গাছি মালা কবির পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। মনে হইতেছিল, বাংলা দেশের বর্ষাঋতুর খানিকটা যেন ধরিয়া আনিয়া এই গৃহের মধ্যে জীবন্ত করিয়া রাখা হইয়াছে। চারিধার হইতে সব কিছুই মূক ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলিতেছিল। কবি যদি আমার সঙ্গে কোন কথাই না বলিতেন তবু আমি অনুতাপ করিতাম না। এই গৈরিক বসন পরিহিত মহামানবের সামনে আসিয়া আজ আমার সমস্ত অন্তর ভরিয়া গিয়াছে। সালাম জানাইয়া কম্পিত হস্তে আমি নক্সীকাঁথার মাঠ আর রাখালী’ পুস্তক দুইখানি কবিকে উপহার দিলাম। কবি বই দুইখানি একটু নাড়িয়া চাড়িয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমার মনে হচ্ছে তুমি বাংলা দেশের চাষী মুসলমানদের বিষয়ে লিখেছ। তোমার বই আমি পড়ব।”