নিজের বাড়িতে সে বাঁশী বাজাইতে পারিত না। বাড়ির মেয়েরা বাঁশীর সুরে উদাসী হইয়া যাইবে বলিয়া গ্রামবাসীরা তাহাকে ধরিয়া মার দিত। গভীর রাতে যখন সকলে ঘুমাইয়া পড়িত, তখন সে গ্রাম হইতে বাহিরে আসিয়া মাঠের মধ্যস্থলে বসিরা বাঁশী বাজাইত। তাহার বাঁশীতে ‘জল ভর সুন্দরী কন্যা’ গানটি শুনিয়া কোন যুবতী নারী নাকি একদিন ঘরের বাহির হইয়া আসিয়াছিল।
এই গুণী লোকটি ছিল আমার আত্মার আত্মীয়। দেশে গিয়া প্রায়ই তাহাকে ডাকিয়া তাহার বাঁশী গুনিতাম। মনে হইল, এমন গুণী লোককে কলিকাতা লইয়া গেলে সেখানকার লোকে নিশ্চয় উহার বাঁশী শুনিয়া তারিফ করিবে।
কালা মিয়াকে কলিকাতা আনিয়া গ্রামোফোন কোম্পানিগুলিতে অনেক ঘোরাঘুরি করিলাম। কেউ তার বাঁশী রেকর্ড করিতে চাহিল না। নাট্টাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে একদিন তার বাঁশী শুনাইলাম। গুণীজনের সমাদর করিতে তাঁর মত আর কেহ জানিত না। বাঁশী শুনিয়া তিনি মুগ্ধ হইলেন। তার অর্কেস্ট্রাতে কালা মিয়াকে বাজাইবার হুকুম দিলেন। কিন্তু দিলে কি হইবে? অর্কেস্ট্রার বাজিয়েদের সুরের সঙ্গে বাঁশীর সুরের পর্দা মেলেনা। কারণ অর্কেস্ট্রার একটি পদ খালি হইলেই বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনকে আনিয়া বসাইতে পারে, তাই তারা আপদবিদায় হইলে বাঁচে। যদি তারা সময় দিত, এই গ্রাম্য যুবকটিকে স্নেহমমতার সঙ্গে তাহাদের যন্ত্রের সঙ্গে পরিচিত করাইত, সে হয়ত পরিণামে তাহাদের সুরের সঙ্গে সুর মিলাইয়া বাঁশী বাজাইতে পারিত। বাঁশী বাজিয়ে অভিযোগ করিতে লাগিল। শিশিরবাবু বিরক্ত হইরা তাহাকে ছাড়াইয়া দিলেন।
অবনীন্দ্রনাথকে এই বাঁশী আগেই শুনাইয়াছি। তিনি খুব তারিফ করিয়াছেন। কিন্তু তাহাদের জমিদারী তখন কোর্ট অফ ওয়ার্ডসে যাইতেছে। টাকা-পয়সার দিক দিয়া তিনি কোনই সাহায্যকরিতে পারিবেন না। আগেকার দিন হইলে এককথায় হাজার ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দিতেন। ভাবিলাম, রবীন্দ্রনাথকে বাঁশী শুনাইব। যদি তাহার ভাল লাগে, হয়ত তিনি তাকে শান্তিনিকেতনে লইয়া যাইবেন।
আমার সকল নাট্যের কাণ্ডারী মোহনলালের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া কবিকে এই বাঁশী শুনাইবার এক অভিনব পন্থা আবিষ্কার করিলাম। রবীন্দ্রনাথ তখন থাকিতেন পূবের দোতলায়। অবনীন্দ্রনাথের বাড়ির উত্তরের গাড়ি-বারান্দার দোতালায় কালা মিয়াকে বসাইয়া বাঁশী বাজাইতে বলিলাম। কালা মিয়া বাঁশীতে সুর দিয়া বাজাইয়া চলিল—“রাধা বলে ভাইরে সুবল আমি আর কত বাজাব বাঁশী। আমরা নিচে দাঁড়াইয়া রবীন্দ্রনাথের আনাগোনা লক্ষ্য করিতে লাগিলাম। বাঁশী শুনিয়া কবির ভাবান্তর জানিবার জন্য মোহনলালের দাদামশাই সমরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আগেই রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। কালা মিয়া আবার বাঁশীতে গান ধরিল :
জাইত গেল বাইদার সাথে
জাইত গেল কুল গেল ভাঙল সুখের আশা
ওরে, রজনী পরভাতের কালে পাখী ছাড়ল বাসা রে—
বিলম্বিত সুরের মুর্ছনা আকাশ-বাতাস আছড়াইয়া কাঁদিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে আসিয়া বারান্দার উপর দাঁড়াইলেন। কয়েক মিনিট থাকিয়া ঘরে ফিরিয়া গেলেন। সমরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের ঘর হইতে ফিরিয়া আসিলেন। আমরা জানিতাম, এই বাঁশী শুনিয়া কবি খুবই খুশি হইবেন। সেই কথা শুনিবার জন্য তাঁহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইলাম। সমরেন্দ্রনাথের কাছে শুনিলাম, রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, দেখ ত কে আমাকে এই সকালবেলা এমন একঘেয়ে করুণ সুরের বাঁশী শুনায়। সকালবেলা কি এই সুর শোনার সময়? এই কথা শুনিয়া মনে মনে খুবই ব্যথা পাইলাম। বুঝিলাম এই বাঁশী শোনার মনোভাব কবির তখন ছিল না। অন্য সময় যদি শুনাইতে পারিতাম, কবি হয়ত বাঁশী পছন্দ করিতেন। কালু মিয়া দেশে ফিরিয়া গেল। কলিকাতার কোন গুণগ্রাহী এই মহাগুণীর আদর করিল না। দেশে গিয়া সে রিক্সাচালকের কাজ করিত। অমানুষিক পরিশ্রম ও অল্প আহারে যক্ষ্মা-রোগগ্রস্ত হইয়া সে চিরকালের মত ঘুমাইয়াছে। তাহার মত অমন মধুর বাঁশীর রব আর কোথাও শুনিতে পাইব না।
আজ পরিণত বয়সে বুঝিতেছি যে, কবি কোন দিনই এই বাঁশী শুনিয়া আমাদের মতন মুগ্ধ হইতেন না। কবি যখন সাহিত্য আরম্ভ করেন, তখন সমস্ত দেশ পল্লীগানে মুখর ছিল। কালা মিয়ার চাইতে সহস্রগুণের ভাল বাঁশী-বাজিয়ের সুর তিনি শুনিয়াছিলেন। লোক-সাহিত্যের উপর কয়েকটি প্রবন্ধ লেখা ছাড়া তাহাদের সুর বা কৃষ্টি রক্ষা করিতে তিনি বিশেষ কিছুই করেন নাই। ইংরেজ-আগমনের সময় আমাদের বাংলা সাহিত্য ছিল জনসাধারণের। বিদেশি সাহিত্যের ভাবধারা আর প্রকাশ-ভঙ্গিমার উপর পল্লব মেলিয়া নব্য বাঙালিরা যে সাহিত্য তৈরি করিলেন, রবীন্দ্রনাথের হাতে পড়িয়া সে সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যে পরিণত হইল। পরলোকগত চিত্তরঞ্জনের অনুগামীরা ছাড়া সমস্ত দেশ বিস্ময়ে এই মহাস্রষ্টার পায়ে প্রণামাঞ্জলি রচনা করিল। সমস্ত কথা বলিবার সময় এখনো আসে নাই। আর ধান ভানিতে শিবের গীত গাহিয়াই বা কি হইবে। আমি রবীন্দ্রস্মৃতিকথা লিখিতেছি। একবার গ্রাম-গানের বিষয়ে কবির সঙ্গে আলাপ হইল। কবি বলিলেন, “দেখ, তোমাদের গ্রাম্যগানের সুর হুবহু শেখার সুযোগ আমার হয় নি। যা একটু সুরের কাঠামো পেয়েছি, তার সঙ্গে আমার সুর মিশে অন্য একটা কিছু তৈরি হয়েছে।’
আমি বলিলাম, ‘সেই জন্যই আপনার বাউল-সুরের গানগুলির অনুরূপ সুর আমি কোথাও খুঁজে পাইনে।’