ঠাকুর-বাড়িতে থাকিলে এপ্রিল মাসের প্রথম তারিখে আমরা অনেক আজব কাণ্ড করিতাম। এই সুখী পরিবার কোনকিছু উপলক্ষ করিয়া হাসিতামাসার সুযোগ পাইলে তাহা ছাড়িত না। আমার কোন কবিবন্ধুকে ঠাট্টা করিয়া কবিতায় একটি পত্র লিখিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম, কোন কৌশলে তাহা বন্ধুবরের পকেটে রাখিয়া আসিব। ঠাকুরবাড়ির একটি ছোট ছেলে ছো মারিয়া সেটা লইয়া গিয়া এনভেলপে ভরিয়া রবীন্দ্রনাথের ঠিকানা লিখিয়া কবিকে দিয়া আসিল। আমি ত ভয়ে বাঁচি না। একে কবিতাটি রচনা হিসেবে একেবারে কাঁচা, তাহা ছাড়া বন্ধুকে লইয়া যে বিদ্রুপ করিয়াছি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে লইয়া তাহা পারা যায় না। কবি না জানি আমাকে কি বলিবেন? আমার শিল্পীবন্ধু ব্বতীন্দ্রনাথ ঠাকুর গিয়া কবিকে সকল কথা খুলিয়া বলিলেন। কবি আমাকে ডাকাইয়া লইয়া বলিলেন, এতে তুমি এত মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছ কেন? আমি কিছু মনে করি নি, বরঞ্চ বেশ আনন্দ পেয়েছি। তারপর যাহাতে এজন্য আমার মনে লেশমাত্র অনুতাপ না থাকে—কবি সস্নেহে আমার সঙ্গে অনেক গল্প করিলেন। অতি-আধুনিক কবিদের বিষয়ে আলোচনা হইল। আমি বলিলাম, আজকাল একদল অতি-আধুনিক কবির উদয় হয়েছে। এরা বলে, সেই মান্ধাতার আমলের চাঁদ, জোছনা ও মৃগনয়নের উপমা আর চলবে না; নতুন করে উপমা-অলঙ্কার গড়ে নিতে হবে। গদ্যকে এরা কবিতার মত করে সাজায়। তাতে মিল আর ছন্দের আরোপ বাহুল্যমাত্র। এলিয়টের আর এজরা পাউণ্ডের মত করে এরা লিখতে চায়। বলুন ত একজনের মতন করে লিখলে তা কবিতা হবে কেন? কবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যদি না থাকল তার প্রকাশে, তাকে কবি বলে স্বীকার করব কেন? দিনে দিনে এদের দল বেড়ে যাচ্ছে। এরা অনেকেই বেশ পড়াশুনো করে। বিশেষ করে ইংরেজী-সাহিত্য। তারই দৌলতে এরা নিজের দলের স্বপক্ষে বেশ জোরাল প্রবন্ধ লেখে।
কবি বলিলেন, ‘এজন্য চিন্তা করো না। এটা সাময়িক ঘটনা। মেকির আদর বেশী দিন চলে না। একথা জেনো, ভাল লেখকদের সংখ্যা সকল কালেই খুব কম। আর মন্দ লেখকেরা সংখ্যায় যেমন বেশী, শক্তির দাপটে তেমনি অজেয়। কিন্তু কালের মহাপুরুষ চিরকালই সেই অল্পসংখ্যক দুর্বল লেখকদের হাতে জয়পতাকা তুলে দিয়েছেন।’
আজ বহুদিন পরে মনের অস্পষ্ট স্মৃতি হইতে এইসব কথা লিখিতেছি। উপরের কথাগুলি কবি ঠিক এইভাবেই যে বলিয়াছিলেন, তাহা হলপ করিয়া বলিতে পারি না।
তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথের গানের তেমন আদর হয় নাই। রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড হইলে দুই-শ আড়াই-শর বেশি বিক্রয় হইত না। একদিন কবির সঙ্গে তার গানের সুরের বিষয়ে আলোচনা হইল। আমি বলিলাম, ‘আজকাল আধুনিক গায়কেরা আপনার গান গাইতে চায় না। আপনার গানের ভিতরে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারুকার্য আছে, তা আমাদের অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করে। সাধারণ গায়কেরা সেই সূক্ষ্ম কারুকার্যের আদর করিতে জানে না। তারা গানের সুরে স্থূল ধরনের কারুকার্য চায়। যা হলে শ্রোতারা বাহবা দিতে পারে। তাই দখতে পাই, আপনার গানের ভাষার অনুকরণে যারা গান লেখে, সেই সব গানে স্থূল ধরনের সুর লাগিয়ে তারা আসর সরগরম করতে চায়। কবি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘এটাও একটা সাময়িক ব্যাপার। এগুলোর আদর বেশী দিন টিকবে না।’
একবার কথাপ্রসঙ্গে কবিকে বলিলাম, ‘আপনার কবিতার ভাষায় এমন অপূর্ব ধ্বনিতরঙ্গ তোলে—কোথাও এমন একটি শব্দ আপনি ব্যবহার করেন নি, যেটাকে বদলিয়ে আর একটি বসান যায়। এত লখেছেন, কোন লেখার একটি শব্দও মনে হয় না অস্থানে পড়েছে। আপনার ঐ যে গান–
গ্রামছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ
ওরে, আমার মন ভুলায় রে—
কী সুন্দর রহস্যলোকে মন উধাও হয়ে যায় শব্দের আর সুরের পাখায়। কিন্তু যেখানটিতে আপনি লিখেছেন,
সে যে আমায় নিয়ে যায় রে
নিয়ে যায় কোন চুলায় রে—
এখানে চুলায় কথাটি শুনতে কল্পনার আকাশখানি যেন মাটিতে পড়ে যায়।’
কবি কৃত্রিম কোপ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, ‘তা চুলোয় বলছি তো হয়েছে কি? কথাটি তোদের বাঙাল দেশে হয়ত তেমন চলে না। অথবা অন্য ভাবে আছে।’
কবির সঙ্গে তাঁর আরও কোন কোন কবিতার আলোচনা করিতে চাহিয়াছিলাম। কবি আমাকে বলিলেন, যা, এখন যা। আমার অনেক কাজ আছে। আগে তুই প্রফেসর হ, তখন এসব
তোকে বলব।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ ছাপা হইলে কবিকে পড়িতে দিলাম।
পড়িয়া তিনি খুব প্রশংসা করিলেন। আমি বলিলাম, “আপনি যদি এই বই-এর বিষয় কিছু লিখে দেন, আমি ধন্য হব”।
শান্তিনিকেতনে গিয়া কবি পত্র লিখিলেন—‘তোমার সোজন বাদিয়ার ঘাট অতীব প্রশংসার যোগ্য। এ বই যে বাংলার পাঠকসমাজে আদৃত হবে সে বিষয়ে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নাই।’
কবির ঐ ভবিষ্যৎবাণী সার্থক হইয়াছে। বই খুব জনপ্রিয় হইয়াছে। ইউনেস্কো হইতে ইংরাজি অনুবাদও শীঘ্র বাহির হইবে।
আমার পাশ্ববর্তী গ্রামের একটি মুসলমান চাষী ভাল বাঁশী বাজাইতে জানিত। কতদিন তাকে ডাকিয়া আনিয়া আমাদের পদ্মাতীরের বাড়িরধারে বাঁশঝাড়ে সারারাত জাগিয়া বাঁশী শুনিয়াছি। ঝাড়ের বাঁশ কাটিয়া নিজের ইচ্ছামত ছিদ্র তৈরি করিয়া সে তার হাতের বাঁশী তৈরি করিয়াছিল। হারমোনিয়ামের সা-রে-গা-মা-র সঙ্গে বাঁশীর ছিদ্রগুলির কোনই মিল ছিলনা। কিন্তু বিচ্ছেদ, বারমাসী ও রাখালী সুরের সবখানি মধু বাঁশীতে সে ঢালিয়া দিতে পারিত। গভীর রাত্রিকালে সে যখন বেহুলাসুন্দরীর গান ধরিত, তখন যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইতাম, আমাদেরই পদ্মা নদী দিয়া কলার মান্দাসে অভাগিনী বেহুলা লক্ষ্মীন্দরকে লইয়া ভাসিয়া চলিয়াছে।