সুতরাং আমার সেখানে সূচ্যগ্ব-প্রবেশেরও আশা নাই। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মুকুটহীন রাজা। আমি গিয়া রবীন্দ্রনাথকে ধরিলাম। গ্রাম্য-গান নিয়ে আমি কিছু কাজ করেছি। গবেষকের কাজটি যদি পাই, আমার সেই অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করিতে পারি।
কবি হাসিমুখে আমার জন্য শ্যামাপ্রসাদকে একখানা সুপারিশ-পত্র লিখিয়া দিলেন।
রবীন্দ্রনাথের পত্রের গুণে এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহৎপ্রাণ মিণ্টো-প্রফেসার ডাঃ প্রমথনাথ ব্যানার্জী ও স্যার হাসান সারওয়ার্দীর চেষ্টায় আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-গবেষক নিযুক্ত হইলাম। নিয়োগপত্র পাইয়াই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করিয়া বলিলাম, “আপনার পত্রের জন্যে আমি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পেয়েছি।”
কবি বলিলেন, ‘তুমি আমাকে বড়ই আশ্চর্য করে দিলে হে। আমার কাছে কেউ কোন উপকার পেয়ে কোন দিন তা স্বীকার করে না।’
তখনকার দিনে দেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়াইয়া ছিল। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তার এতটুকুও প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। যখনই যেজন্য তাহার নিকটে গিয়াছি, তিনি হাসিমুখে তাহা করিয়া দিয়াছেন। মুসলমান বলিয়া তিনি আমাকে দূরে সরাইয়া রাখেন নাই। এখানে একটি দৃষ্টান্ত দিব।
স্যার এফ রহমান সাহেব তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্সেলার। তিনি আমাকে বলিলেন, রবীন্দ্রনাথ অথবা অন্য কোন নামকরা লোকের কাছ থেকে যদি কোন ব্যক্তিগত পত্র আনতে পার, তবে এখানে বাংলা-বিভাগে তোমার জন্য কাজের চেষ্টা করতে পারি। এম, এ, পাশ করিয়া তখন বহুদিন বেকার অবস্থায় চাকুরীর জন্য ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। আমি তৎক্ষণাৎ কলিকাতা চলিয়া আসিলাম।
কলিকাতা আসিয়া বাংলা-সাহিত্যের দুইজন দিকপালের সঙ্গে দেখা করিলাম। তাঁহারা কেহই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার নিয়োগ সমর্থন করিয়া কোন পত্র দিতে চাহিলেন না। একজন তো স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিলেন, ‘দেখ, আজকাল সাম্প্রদায়িকতার দিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শত্রুর অভাব নাই। হয়ত কোন হিন্দু এই কাজের জন্য চেষ্টা করছে। তোমাকে ব্যক্তিগত পত্র দিলে হিন্দু কাগজগুলি আমাকে গাল দিয়ে আস্ত রাখবে না।
আমার তখন দুঃখে ক্ষোভে কাঁদিতে ইচ্ছা হইল। এরা আমাকে এত ভালবাসেন। আমি বেকার হইয়া চাকরীর জন্য কত ঘুরিয়া বেড়াইতেছি এরা একটা চিঠি দিলেই আমার কাজ হইয়া যাইত। অথচ যে হিন্দু প্রার্থীকে এরা চেনেন না, তারই সমর্থনে আমার ব্যক্তিগত পত্র দিলেন না। একবার ভাবিলাম, রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই। তিনি হয়ত আমাকে ব্যক্তিগত পত্র দিবেন। আবার ভাবিলাম, হয়ত তিনিও এদেরই মত আমাকে প্রত্যাখ্যান করিবেন। কী কাজ তাঁহার নিকটে গিয়া!
স্রোতে-পড়া লোক তৃণের আশাও ছাড়িতে চাহে না। আশার ক্ষীণ সূত্রটি কিছুতেই মন হইতে টুটিতে চাহে না। কে যেন আমাকে ঠেলিয়া শান্তিনিকেতনে লইয়া চলিল।
সকালবেলা। কবি বারান্দায় বসিয়াছিলেন। পূর্ব গগনে রঙ্গিলা ভোর মেঘে মেঘে তার নক্সার কাজ তখনও বুনট করিয়া চলিয়াছে। সামনের বাগানে পাখির গানে ফুলের রঙে আর সুবাসে আড়াআড়ি চলিয়াছে। সালাম জানাইয়া কবির সামনে গিয়া দাঁড়াইলাম। কুশলপ্রশ্নের উত্তর দিয়া কবিকে আমার আগমনের কথা বলিলাম। কবি তৎক্ষণাৎ তার প্রাইভেট-সেক্রেটারী অমিয় চক্রবর্তী মহাশয়কে আমার জন্য একখানা সুপারিশপত্র লিখিয়া আনিতে নির্দেশ দিলেন। তখন আমি কবিকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিলাম। কলিকাতার দুইজন সাহিত্যের দিকপাল শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক কারণে আমাকে যে সুপারিশ-পত্র দেন নাই, এ কথাও বলিলাম। সমস্ত শুনিয়া কবি মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন।
বন্ধুবর অজিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিচের তলায় কয়েকখানি কুঠরী ভাড়া লইয়া আমি প্রায় বৎসর খানেক ঠাকুরবাড়িতে ছিলাম। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা আসিলে প্রায়ই তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে যাইতাম। তখন কোন দিন কবির সঙ্গে কী আলাপ হইয়াছিল, স্পষ্ট মনে নাই। কয়েকটি টুকরো কথা উজ্জ্বল উপলখণ্ডের মত মনের নদীতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তাহা এখানে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখি।
একদিন কথা প্রসঙ্গে কবি বলিলেন, দেখ, আমার বিষয়ে লোকে যখন তখন যা-কিছু লিখতে পারে। কেউ কোন উচ্চবাচ্য করে না।
আমি বলিলাম, ‘আপনি কবি, সাহিত্যিক,—আপনাকে নিন্দা করেও সাহিত্য তৈরী হয়। তাই আপনার নিন্দা করা সহজ। কিন্তু একথা নিশ্চয় জানবেন, দেশের শতসহস্র লোক আপনার কবিতা পড়ে আনন্দ পায়—আপনাকে শ্রদ্ধা করে। শ্রদ্ধা অন্তরে অনুভব কববার বস্তু। নিন্দার মত শ্রদ্ধা বাহিরে তত মুখর নয়। আপনাকে যারা শ্রদ্ধা করে আপনি তাদের দেখেন নি।’
কবি অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, পরে উত্তর করিলেন, দেখ মহাত্মা গান্ধীকে ত কেউ নিন্দা করতে সাহস করে না।
আমি বিনীতভাবে উত্তর করিলাম, ‘মহাত্মা গান্ধী বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেও তাঁকে নিন্দা করলে সাহিত্য তৈরী হয় না। আপনার সঙ্গে আপনার নিন্দুকেরাও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চায়। ছুছুন্দরী কাব্যের লেখকের নাম আজ কে মনে রাখত যদি মাইকেলের অমর কাব্যের সঙ্গে এই কাব্য জড়িত না থাকত?
এই আলোচনার পরে দেশে এমন দিনও আসিয়াছিল, যে জনতা গান্ধীজীকে মহাত্মা না বলিলে ক্ষেপিয়া যাইত, তাহারাই তাহার গায়ে ইষ্টক নিক্ষেপ করিয়াছে—তাহার গাড়ি আক্রমণ করিয়াছে। পরিশেষে সেই জনতার একজনের হাতেই গান্ধীজীকে জীবন পর্যন্ত দিতে হইল।