এই প্রস্তাবে কবি রাজি হইলেন। ইহার পর নানা কাজের ঝাটে আমি প্রবন্ধটি লিখিয়া কবিকে পাঠাইতে পারি নাই।
কবির সংকলন-পুস্তক ইহার কিছুদিন পরেই বাহির হয়। এই সংকলনে কবি ময়মনসিংহ-গীতিকা হইতে অংশবিশেষ গ্রহণ করিয়াছেন। ক্ষিতিমোহনবাবুর সংগ্রহ হইতেও কিছু কিছু লইয়াছেন।
রিপন কলেজে বাংলা ভাষার অধ্যাপকের পদ খালি হইল। এই পদের জন্য আমি দরখাস্ত করি। তখন রিপন কলেজের কার্য-পরিষদের সভাপতি ছিলেন শ্রীযুক্ত জে, চৌধুরী। শুনিতে পাইলাম, রবীন্দ্রনাথ এই পদের জন্য একজনকে সমর্থন করিয়া জে, চৌধুরীর নিকট সুপারিশ পত্র দিয়াছেন। চৌধুরী মহাশয় কলিকাতা ল-রিপাের্টর সম্পাদক ছিলেন হাইকোর্টের বিদায়ী প্রধান বিচারক শ্রদ্ধেয় এফণিভূষণ চক্রবর্তী মহাশয় তখন তরুণ এডভোকেট, শ্রীযুক্ত চৌধুরীর সহকারী। তিনি আমাকে বড়ই ভালবাসিতেন। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে গ্রাম্য-গান লইয়া আলোচনা করিতেন। রিপন কলেজের এই কাজটি যাহাতে আমার হয়, সেজন্য তিনি অশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমি এম. এ. পাশ করিলাম ১৯৩১ সনে, কিন্তু ১৯৩৭ সন পর্যন্ত কোথাও কোন চাকুরী পাইলাম না। কোনও বাংলার ভাল পদ খালি হইলে সেই পদের সঙ্গে কিছু সংস্কৃত পড়ানোর কাজও জুড়িয়া দেওয়া হইত। সুতরাং কোন গভর্নমেন্ট-কলেজে চাকুরী পাইবার দরখাস্ত করার সুযোগ মিলিত না। বেসরকারী কলেজে বাংলা পড়ানোর পদ খালি হইলে তাহারা অভিজ্ঞ শিক্ষকের জন্য বিজ্ঞাপন দিতেন। শিক্ষাকার্যে অভিজ্ঞতা অর্জন করারও আমি কোন সুযোগ পাইলাম না। তা ছাড়া কোন কলেজের চাকুরীর তদ্বির করার মত আমার কোন অভিভাবকও ছিল না। কিন্তু রিপন কলেজের চাকুরীর জন্য ফণীবাবু ও ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আমার জন্য বহুভাবে তদ্বির করিয়াছিলেন। একদিন ফণীবাবু আমাকে বলিয়াদিলেন, তুমি যদি রবীন্দ্রনাথের নিকট হইতে শ্বীযুক্ত চৌধুরীর নামে কোন সুপারিশ-পত্ব আনিতে পার, তবে এখানে তোমার চাকুরী হইতে পারে। এই বিষয়ে আমি ধূর্জটিবাবুর সঙ্গে আলাপ করিলাম। তিনি আমাকে বলিলেন, তুমি শান্তিনিকেতনে গিয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা কর। নিশ্চয় তিনি তোমাকে সুপারিশ পত্র দিবেন। আমি শান্তিনিকেতনে রওনা হইলাম।
রবীন্দ্রনাথ তখন শ্যামলী নামক গৃহে অবস্থান করিতেছিলেন। শিল্পী নন্দলাল মাটি দিয়া কবির জন্য এই সুদৃশ্য গৃহটি নির্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন।
কবি অনেকগুলি কাগজপত্র বিছাইয়া লেখাপড়ার কাজে নিমগ্ন ছিলেন। হাসিয়া সস্নেহে আমাকে গ্রহণ করিলেন। কুশলপ্রশ্নের পর আমি কবিকে আমার আগমনের কারণ বলিলাম। কবি উত্তর করিলেন, দেখ, আমার চিঠিতে কারো কোন কাজ হয় না। তুমি মিছামিছি কেন আমার চিঠির জন্য এতদূর এসেছ? আমি সবিনয়ে উত্তর করিলাম, এই কাজের জন্য আপনি অপরকে সুপারিশপত্র দিয়েছেন। আমার যদি এখানে কাজ না হয় তবে মনে করব, আপনার চিঠির জন্যই এখানে আমার কাজটি হল না।
কবি আমার কথার কোনই উত্তর দিলেন না। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিভাষার জন্য কতকগুলি ইংরেজী শব্দের বাংলা তর্জমা করিতেছিলেন। তাহা হইতে দুই একটি শব্দের বাংলা আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি তাহার সঠিক উত্তর দিতে পারিলাম। তখন কৌশলে আমি আবার সেই ব্যক্তিগত পত্রের কথা উল্লেখ করিলাম। কবিকে বলিলাম, অতদূর থেকে আপনার কাছে এসেছি। আপনি সমুদ্র। এখানে এসে আমি শূন্য হাতে ফিরে যাব, এ দুঃখ আমার চির-জীবন থাকবে। কবি একটু হাসিয়া তাঁহার প্রাইভেট সেক্রেটারী অনিল চন্দকে ডাকিয়া বলিলেন, দেখ, মাইল্ড গোছের একটি চিঠি লিখে এনে দাও। ও কিছুতেই ছাড়বে না।
অনিলবাবু ইংরেজীতে একটি চিঠি লিখিয়া আনিলেন, তাহাতে আমার গুণপনার পরিচয় দিয়া লিখিলেন, আমার উপর যেন সুবিচার করা হয়। যদিও ঐটি ব্যক্তিগত পত্র, তবু এখানে আমার জন্য বিশেষ কোন সুপারিশ করা হইল না। তাই কবিকে ধরিলাম, এখানে বাংলা করে লিখে দিন, জসীমউদ্দীনের যদি এখানে কাজ হয় আমি সুখী হব। কবি হাসিতে হাসিতে তাহাই লিখিয়া দিলেন। রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথও আমার জন্য সুপারিশ করিয়া শ্বীযুক্ত চৌধুরীর নামে একটি ব্যক্তিগত পত্র লিখিয়া দিলেন। সেই পত্র আনিয়া শ্বীযুক্ত চৌধুরী মহাশয়কে দিলাম।
রিপন কলেজে সেবার আমার চাকুরী হইল না। রবীন্দ্রনাথ আগে যাহাকে ব্যক্তিগত পত্র দিয়াছিলেন, তাহার চাকুরী হইল। শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের পত্রের জন্য তাহার চাকুরী হয় নাই। তাহার চাকুরী হইল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তাহার স্থান আমার উপরে ছিল বলিয়া। তবে আমার মত সাহিত্যিক খ্যাতি তাহার তখনও হয় নাই। ধুর্জটিপ্রসাদ এবং ফণীবাবুর চেষ্টায় এবং রবীন্দ্রনাথের পত্রের গুণে রিপন কলেজের কর্তৃপক্ষ আমার প্রতি খুবই আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। তাঁহারা আমাকে আপাতত রিপন ইস্কুলের একটি মাস্টারী দিতে চাহিলেন এবং বলিলেন, এর পরে নতুন কোন পদ খালি হইলে আপনাকে আমরা কলেজের সামিল করিয়া লইব। আমি তাহা গ্রহণ করি নাই।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সেবার গবেষক নিয়োগ করা হয়। সেটা বোধ হয় ১৯৩২ সন। তখন রবীন্দ্রনাথ বাংলা বিভাগের প্রধান কর্তা। শুনিলাম, পাঁচজনকে নিয়োগ-পত্র দেওয়া হইবে। রবীন্দ্রনাথ তাহার শান্তিনিকেতনের দুইজন ছাত্রের জন্য সুপারিশ করিবেন। বাকি তিনজনের মধ্যে অন্যান্য কর্তাব্যক্তিদের নিজস্ব লোক রহিয়াছে।