একদিন কবি বলিতে লাগিলেন, দেখ, জমিদারির তদারক করতে সাজাদপুরে যেতাম। আমাদের একজন বুড়ো প্রজা ছিল। যৌবনকালে সে অনেক ডাকাতি করেছে। বুড়ো বয়সে সে আর ডাকাতি করতে যেত না। কিন্তু ডাকাতরা তাকে বড়ই মানত। একবার আমাদের এক প্রজা অন্য দেশে নৌকা করে ব্যবসা করতে যায়। ডাকাতের দল এসে নৌকা ঘিরে ধরল। তখন সে আমাদের জমিদারির সেই বুড়ো প্রজার নাম করল। তারা নৌকা ছেড়ে চলে গেল। এই বলে চলে গেল, ও তোমরা অমুক দেশের অমুকের গাঁয়ের লোক—যাও, তোমাদের কোন ভয় নেই। সেই বৃদ্ধ মুসলমান আমাকে বড়ই ভালবাসত। তখন নতুন বয়স। আমি জমিদারির তদারক করতে এসেছি। বুড়ো প্রায় পাঁচশ প্রজা কাছারির সামনে ডেকে নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, এত লোক ডেকে এনেছ কেন? সে উত্তর করল, ওরা আপনাকে দেখতে এসেছে। ওরে তোরা দেখ। একবার প্রাণভরে সোনার চাঁদ দেখে নে। আমি দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলাম।
কবি বাংলা কবিতার একটি সংকলন বাহির করিবেন। আমাকে বলিলেন, তোমার সংগ্রহ থেকে কিছু গ্রাম্য গান আমাকে দিও। আমার বইয়ে ছাপাব।
আমি কতকগুলি গ্রাম্য গান কবিকে দিয়ে আসিলাম। তাহার চার-পাঁচ দিন পর প্রশান্ত মহলানবীশের গৃহে কবির সঙ্গে দেখা করিলাম। শ্রীযুক্ত ও শ্রীমতী মহলানবীশ তখন কবির কাছে ছিলেন। কবি আমাকে দেখিয়া বলিলেন, “ওহে, তোমার সংগ্রহকরা গানগুলি পড়লাম। আমাদের দেশের রসপিপাসুরা ওগুলোর আদর করবে। কিন্তু আমি বইটি সংকলন করছি বিদেশী সাহিত্যিকদের জন্যে। অনুবাদে এগুলির কিছুই থাকবে না। ময়মনসিংহগীতিকা থেকে কিছু নিলাম, আর ক্ষিতিমোহনের সংগ্রহ থেকেও কিছু নেওয়া গেল?
আমি বলিলাম, ‘ময়মনসিংহ-গীতিকার’ গানগুলি শুধুমাত্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বইয়ে পাওয়া যায়। ময়মনসিংহে সাত আট বৎসর গ্রাম হতে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি, কোথাও এই ধরনের মাজাঘষা সংস্করণের গীতিকা পাওয়া যায় না। গ্রাম-গাঁথার একটা কাঠামো সংগ্রহ করে চন্দ্রকুমার দে তার উপর নানা রচনা-কার্যের বুনট পরিয়ে দীনেশবাবুকে দিয়েছেন। তাই পল্লীর অশিক্ষিত কবিদের নামে চলে যাচ্ছে।
কবি বলিলেন, কিন্তু ময়মনসিংহ-গীতিকায় কোন কোন জায়গায় এমন সব অংশ আছে যা চন্দ্রকুমার দে’র রচিত বলে মনে হয় না।
আমি উত্তর করিলাম, এ কথা সত্য। এই অংশগুলি প্রচলিত ছোট ঘোট গ্রাম্য গান। চন্দ্রকুমারবাবু এগুলি সংগ্রহ করে সেই প্রচলিত পল্লীগীতিকার কাঠামোর মধ্যে ভরে দিয়েছেন। ময়মনসিংহগীতিকার সেই অংশগুলিই দেশ-বিদেশের সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তা ছাড়া পল্লীগীতিকার কাহিনীর যে কাঠামোর উপরে এই ধরনের বুনট-কার্য হয়েছে, সেই গল্পাংশেরও একটা মূল্য আছে।
কবি বলিলেন, আমাদের ক্ষিতিমোহনের সংগ্রহগুলি তো চমৎকার।
আমি উত্তর করিলাম, ক্ষিতিমোহনবাবুর সংগ্রহগুলি আমি দেখি নাই। প্রবাসীতে ‘বাউল’ নামক প্রবন্ধে চারুবাবু কতকগুলি গ্রাম্য গান প্রকাশ করেছেন। সেগুলি নাকি ক্ষিতিমোহনবাবুর সংগ্রহ হতে নেওয়া। তার থেকে কয়েকটি লাইন আপনাকে শুনাই—
কমল মেলে কি আঁখি, তার সঙ্গে না দেখি
তারে অরুণ এসে দিল দোলা রাতের শয়নে,
আমি মেলুম্ না, মেলুম না নয়ন
যদি না দেখি তার প্রথম চাওনে।
আপনি কি বলবেন, এসব লাইন কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য বাউলের রচিত হতে পারে। আপনার কবিতার ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিমার সঙ্গে যাদের পরিচয় নেই, এমন লাইন তারা রচনা করতে পারে? ক্ষিতিমোহনবাবুর আরও একটি গানের পদ শুনুন–
ও আমার নিঠুর গরজী,
তুই মানস-মুকুল ভাজবি আগুনে।
এই মানস-মুকুল কথাটি কি কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য লোক জানে? এই গানটি কি আপনার ‘তোর কেউ পারবি না রে পারবি না ফুল ফোটাতে’ মনে করিয়ে দেয় না?
কবি খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন। তারপর উত্তর করিলেন, তাইত ভাবি, এঁরা যদি আগেই এরূপ লিখে গেলেন, তবে আমাদের পরে আসার কি সার্থকতা থাকল?
আমি কবিকে বলিলাম, আপনি কি কোন প্রবন্ধে এইসব তথাকথিত গ্রাম-গানগুলির বিষয়ে আপনার অভিমত লিখবেন? আপনি যদি লেখেন, তবে দেশের বড় উপকার হবে। যারা খাঁটি গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করেন, তাদের সংগ্রহের আদর হবে।
কবি উত্তর করিলেন, “দেখ, ক্ষিতিমোহন আমার ওখানে আছে, তার সংগ্রহ-বিষয়ে আমি কিছু বিরুদ্ধ মত দিয়ে তার মনে আঘাত দিতে চাই নে।”
প্রশান্তবাবু আমাকে বলিলেন, আপনি এ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন না কেন? আমি বলিলাম, দীনেশবাবু আমার জীবনের সব চাইতে উপকারী বন্ধু। কত ভাবে যে তিনি আমাকে সাহায্য করেছেন তার ইয়ত্তা নাই। আমি যদি এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখি, তিনি বড়ই ব্যথা পাবেন। পূর্বের কথাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমি কবিকে বলিলাম, আপনার সংকলন-পুস্তকে যদি এই সব গান গ্রাম্য-সাহিত্যের নামে চলে যায়, তবে এর পরে যারা খাঁটি গ্রাম-গান সংগ্রহ করবেন, তাদের বড়ই বেগ পেতে হবে। কারণ এই সব সংগ্রহের সঙ্গে প্রচলিত আধুনিক সাহিত্যের মিশ্রণ আছে বলে সাধারণ পাঠকের দৃষ্টি এদিকে আকৃষ্ট হয়। তারা এগুলি পড়ে বলে, দেখ দেখ, অশিক্ষিত গ্রাম্য কবিরা কেমন আধুনিক কবিদের মত লিখেছে। যারা বহু পরিশ্রম করে খাঁটি গ্রাম্য-গান সংগ্রহ করেন, তাদের সংগ্রহ পড়ে বিশেষজ্ঞরা পর্যন্ত বলেন, অমুকের সংগ্রহের চাইতে তোমার সংগ্রহ অনেক নিম্নস্তরের।
এই সময়ে প্রশান্তবাবু বলিলেন, আচ্ছা, এক কাজ করলে হয় না। আপনি তথাকথিত গ্রাম-গানগুলির বিষয়ে বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখে গুরুদেবের নিকট দাখিল করুন। গুরুদেব ওর উপরে মন্তব্য লিখে দিলে লেখাঁটি গুরুদেবের মন্তব্য সহ সীল করে রাখা হবে। এর পর বহু বৎসর পরে প্রয়োজন হলে গুরুদেবের মন্তব্য সহ প্রবন্ধটি সাধারণের দরবারে হাজির করা যাবে।