- বইয়ের নামঃ ঠাকুর-বাড়ির আঙিনায়
- লেখকের নামঃ জসীম উদ্দীন
- প্রকাশনাঃ পলাশ প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
০১. রবীন্দ্র-তীর্থে
এতদিন পরে কিছুতেই ভালমত মনে করিতে পারিতেছি না, কোন সময়ে প্রথম রবীন্দ্রনাথের নাম শুনি। আবছা একটু মনে পড়িতেছে, আমাদের গ্রামের নদীর ধারে দুইটি ভদ্রলোক কথা বলিতেছিলেন।
একজন বলিলেন, “অমুক কবি কবিতা লিখে এক লক্ষ টাকা পেয়েছেন।” সেই এক লক্ষ টাকার বিরাট অঙ্কের পিছনে কবির নামটি ঢাকা পড়িয়াছিল। তারপর কবির সঙ্গে মনের পরিচয় হইল ‘প্রবাসী’তে তাহার জীবন-স্মৃতি পড়িয়া। অল্প বয়সের সেই কিশোর বেলায় আর একজন কিশোর কবির প্রথম জীবনের কাহিনীর ভিতর দিয়া সেদিন যে মিলন-লতাটি রচিত হইল, তাহাতে ফুল ফুটিয়া গন্ধ ছড়াইয়া আমার সমস্ত জীবন অমোদিত করিয়াছে। কবি কোথায় রেলগাড়িতে বেড়াইতে গিয়াছিলেন, জানালার পথে দৃষ্টি মেলিয়া পথের পাশের প্রতিটি দৃশ্যকে কি ভাবে তিনি সমস্ত অন্তর দিয়া অনুভব করিয়াছিলেন, কোথায় অবস্থান কালে সকাল হইতে দুপুর দুপুর হইতে সন্ধ্যা সেখানকার প্রতিটি গাছ লতা পাতার দিকে কবি চাহিয়া থাকিতেম, পদ্মানদীতে বোটে বসিয়া মাত্র একবাটি দুধ পান করিয়া সারাদিন তিনি লিখিয়া যাইতেন, এই সব কত যে একনিষ্ঠ ভাবে অনুকরণ করিতাম সে কথা ভাবিলে আজ হাসি পায়।
তারপর বুঝিয়া না বুঝিয়া কবির বইগুলি যেখান যেখানে পাইয়াছি পড়িয়া গিয়াছি। সব বুঝিতে পারি নাই, কিন্তু ভাল লাগিয়াছে। হয়ত কবির রচনায় যে অপূর্ব সুরের মাদক আছে, তাহারই পরশ আমার অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। এখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা পূর্বাপেক্ষা অধিক বুঝিতে পারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হইয়া কয়েক বৎসর কবির কবিতা ছাত্রদের পড়াইলাম, কিন্তু আগের মত কবিতার মাদকতার স্বাদ এখন পাই না। কিছু বোঝা যায় কিছু বোঝা যায় না—যে সব কবিতায় এই আলো-আঁধারীর ছায়ামায়া থাকে—বোধ হয় সেগুলিতে রসউপভোগের একটি অপূর্ব আস্বাদ থাকিয়া যায়।
তারপর বহুদিন কাটিয়া গিয়াছে। আমার বন্ধুর কলিকাতায় রবীন্দ্রনাথের ‘ফানী’ ‘অচলায়তন’ প্রভৃতির অভিনয় দেখিয়া আসিয়া আমার কাছে গল্প করিয়াছেন। আমি : একান্ত মনে সেই সব গল্প শুনিয়াছি। কতবার যে কবিকে স্বপ্নে দেখিয়াছি তাহার ইয়ত্তা নাই। এই ভাবে বহুদিন কাটিয়া গিয়াছে।
পল্লীগ্রাম ছাড়িয়া একবার কলিকাতা আসিয়াছি। পল্লী-বালকের কল্পনাও সেই কলিকাতা অপূর্ব রহস্যে জীবন্ত হইয়া রহিয়াছে। শুনিতে পাইলাম, ঠাকুরবাড়িতে ‘শেষ বর্ষণ’ অভিনয় হইবে। আমি আট আনা দিয়া সর্বনিম্নের একখানা টিকিট কিনিয়া নির্দিষ্ট আসনে গিয়া উপবেশন করিলাম। তখনও অভিনয় আরম্ভ হয় নাই।
অভিনয়-মঞ্চটি একটি কালো পর্দায় ঘেরা। তাহার সামনে প্রকাণ্ড হলঘরে দর্শকেরা বসিয়াছে। এই গৃহের সব কিছুই আমার কাছে অপূর্ব রহস্যময় বলিয়া মনে হইল। সামনে পিছনে, এধারে ওধারে, যে দিকে চাহি, আমার মনে হয়, আমি যেন কোন অপূর্ব স্বর্গরাজ্যে আসিয়াছি। আমার সামনের আসনগুলিতে নানা সাজ সজ্জায় সজ্জিত হইয়া চারিদিক নানা গন্ধচুর্ণে আমোদিত করিয়া কলিকাতার অভিজাত শ্রেণীর মেয়েরা যে কলগুঞ্জন করিতেছিল—আমার মনে হইল, ইহার চাইতে আকর্ষণীয় কিছু আমি আর কোথাও দেখি নাই। সকলের পিছনে বসিয়াছিলাম বলিয়া আমার আর ও ভাল লাগিতেছিল। পিছন হইতে আমি সকলকেই দেখিতে পাইতেছিলাম। যদি বেশী দামের টিকিট কিনিয়া সামনের আসনে বসিতাম, সেদিন হয়ত আমি কিছুতেই এত খুশী হইতাম না।
বহুক্ষণ পরে সামনের মঞ্চের পর্দা উঠিয়া গেল। বর্ষাকালের যত রকমের ফুল সমস্ত আনিয়া মঞ্চটিকে অপূর্বভাবে সাজান হইয়াছে। সেই মঞ্চের উপর গায়ক-গায়িকা পরিবৃত হইয়া রবীন্দ্রনাথ আসিয়া যখন উপবেশন করিলেন, তখন আমার সামনে উপবিষ্টা সেই রহস্যময়ীরা চাদের আলোতে জোনাকীদের মতো একেবারে স্নান হইয়া গেল। গানের পরে গান চলিতে লাগিল। সে কী গান। পুরুষকণ্ঠে মেয়ে কণ্ঠে, কখনও উচ্চগ্রামে উঠিয়া কখনো একেবারে অস্পষ্ট হইয়া সুরের উপরে সুর বর্ষণ হইতে লাগিল। মাঝে মাঝে গানের বিষয়বস্তু অনুসরণ করিয়া মূক অভিনেতারা মঞ্চের উপর দিয়া চলিয়া যাইতেছিল। সুর ছবি আর পুষ্পগন্ধের অপূর্ব সমন্বয়। শ্রবণ-নয়ন-মন মুগ্ধকর অপূর্ব অভিনয়। তখনও ভদ্রঘরের মেয়েরা মঞ্চে দাঁড়াইয়া নৃত্য করিতে অভ্যস্ত হয় নাই। দুটি মেয়ে মাঝে মাঝে দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া গানের বিষয়বস্তুটি জীবন্ত করিয়া তুলিতেছিল।
শেষবারের মত একটি মেয়ে শুকতারা হইয়া মঞ্চে আসিয়া দাঁড়াইল। কী অপূর্ব তাহার চেহারা! গানের সুর বাজিয়া উঠিল, “শুকতারা ঐ উঠিল আকাশে।” তারপর ধীরে ধীরে শুকতারা মঞ্চ হইতে চলিয়া গেল। একটি মনোমুগ্ধকর স্বপ্ন-জগৎ যেন আমার সামনে দিয়া চলিয়া গেল।
এই ভাবে অভিনয় শেষ হইল। দর্শকেরা কেহই হাতে তালি দিল না। যে যাহার এত নীরবে আসন হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল। কবি মঞ্চের উপর দাঁড়াইলেন। অনেকে আগাইয়া গিয়া কবিকে প্রণাম করিল। আমিও তাহাদের সঙ্গে এক পাশে আসিয়া দাঁড়াইলাম। কিন্তু কবিকে প্রণাম করিলাম না। এই রবীন্দ্রনাথ আমারই রবীন্দ্রনাথ। আর দশজনের মত তাঁহাকে প্রণাম জানাইয়া পথের দশজনের মধ্যেই আবার মিশিয়া যাইব, কবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো এমন নয়। আমি শুধু বদ্ধদৃষ্টিতে কবির মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। কবি সমাগত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়দের সঙ্গে দু-চারিটি কথা বলিতেছিলেন, কিন্তু তাহার মন যেন কোন সুদূর ধ্যানলোকে মগ্ন। এই দৃশ্য ভাবিতে ভাবিতে আমি আমার আশ্রয়স্থানে ফিরিয়া আসিলাম।