কিছু-না-কিছু না করেও মেনক। কিন্তু আরেকটা কাজ করেছেন। সেটা হল উড়িষ্যায় তাঁর টেগোর ভবনে বহু ছাত্রছাত্রীকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাবার চেষ্টা। কটক-ভুবনেশ্বরে ঠাকুরবাড়ির সম্পত্তি আছে। সেখানে কিছুদিন থাকার সময় তার আগ্রহে ও উৎসাহে বেশ কিছু ওড়িয়া ও প্রবাসী বাঙ্গালী ছেলেমেয়ে এসেছিল গান শিখতে। দশ বছরে প্রায় চল্লিশ জনকে গান শিখিয়েছিলেন মেনকা। তারপর তারা আবার কত শিখিয়েছে কে জানে। এখনও দেখা যাবে ওড়িয়াদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার আগ্রহ খুব বেশি। অন্য কোন প্রদেশবাসী রবীন্দ্রনাথের গান
অত উৎসাহ নিয়ে কমই শেখে। মেনকা কলকাতাতেও অনেককে শিখিয়েছেন দিনেন্দ্রনাথের গান। এখনও গান করেন, তবে খুব ছোটাছুটি করতে আর ভাল লাগে না বরং ভাল লাগে গানের মধ্যে হারিয়ে যেতে।
অন্দরমহলের গল্প শেষ। আর ঠাকুরবাড়ির কথা? তার শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে। পতন-অভ্যুদয়ের বন্ধুর পথ পেরিয়ে এই বিশাল পরিবারের উত্তরাধিকারীরা এসে পৌছেছেন বর্তমান যুগে। কিন্তু এখন রবীন্দ্র ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার তো ঠাকুর পরিবারে সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। তার হাতে গড়া শান্তিনিকেতনে, শিষ্য-প্রশিষ্য অনুরাগীদের মধ্যে। সেই পরিবারও বড় হতে হতে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠাকুরবাড়িতে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র ভারতী—পুরনো ঘর বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে নতুন বাড়ি। তবু এক একটা বিশেষ বাড়ি কৌটোর মতো জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময়কে চার দেওয়ালের মধ্যে ধরে রাখে। এই পুরনো দেওয়ালগুলো কত ঘটনার নীরব সাক্ষী। কত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, জল্পনা-কল্পনা, উত্তেজনা-শিহরণ ঘরের কোণে কোণে জমে উঠেছিল তার হিসেব কে রাখে? আজ তো সে শুধু স্বপ্ন। যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে থাকে শুধু ইতিহাস। সে ইতিহাস তো আছেই, চিরকাল তার টানাপোড়েনে বোনা হয়ে থাকবে ঠাকুরবাড়ি থেকে কি পেয়েছি আর কি পাইনি তার হিসেবের নকশা। অবন ঠাকুর বলতেন, মানুষ হিসেব চায় না, চায় গল্প। স্মৃতির ছায়াবীথি বেয়ে আমরা সেই গল্পের জগতেই ফিরে যেতে চেয়েছি যেখানে নানা রঙের সুতোয় বোনা বালুচরী শাড়ির আঁচলার মতোই ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের জীবনের সঙ্গে বোনা হয়ে গেছে বাংলার নারী জাগরণের আলোছায়ার নকশা।
১৭. পরিশিষ্ট, গ্রন্থঋণ, বংশলতিকার সংযোজন
১. সেই কবে পুরুষোত্তমের বংশধর …শুরু করলেন।
(পৃষ্ঠা ৮ পংক্তি ৯.১১)
জগন্নাথের দ্বিতীয় পুত্র পুরুষোত্তম হইতে ঠাকুরবংশের ধারা চলিয়াছে, পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র রামানন্দের দুই পুত্র মহেশ্বর ও শুকদেব হইতে ঠাকুরগোষ্ঠীর কলিকাতা-বাস আরম্ভ।
কথিত আছে, জ্ঞাতি কলহে বিরক্ত হইয়া মহেশ্বর ও শুকদেব নিজ গ্রাম বারোপাড়া হইতে কলিকাতা গ্রামের দক্ষিণে গোবিন্দপুরে আসিয়া বাস করেন। সে সময়ে কলিকাতা ও সুতানুটিতে শেঠ বসাকরা বিখ্যাত বণিক। এই সময়ে ইংরেজদের বাণিজ্যতরণী গোবিন্দপুরের গঙ্গায় আসিয়া দাঁড়াইত। পঞ্চানন কুশারী ইংরেজী কাপ্তেনদের এইসব জাহাজে মালপত্র উঠানে নামানো ও খাদ্য পানীয় সংগ্রহাদি কর্মে প্রবৃত্ত হন। এই সকল শ্রমসাধ্য কর্মে স্থানীয় হিন্দু-সমাজের তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর লোকেরা তাঁহার সহায় ছিল। সেই সকল লোক ভদ্রলোক ব্রাহ্মণকে তো নাম ধরিয়া ডাকিতে পারে না। তাই তাহারা পঞ্চাননকে ঠাকুরমশায় বলিয়া সম্বোধন করিত। কালে জাহাজের কাপ্তেনদের কাছে ইনি পঞ্চানন ঠাকুর নামেই চলিত হইলেন; তাহাদের কাগজপত্রে তাহারা Tagore, Tagoure লিখিতে আরম্ভ করিল। এইভাবে কুশারী পদবীর পরিবর্তে ঠাকুর পদবী প্রচলিত হইল।
–প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় : রবীন্দ্রজীবনী (১ম খণ্ড /পৃষ্ঠা ৩)।
২. সে যুগে ঠাকুরবাড়ির মতো ধনী…লাভ করেছিলেন।
(পৃষ্ঠা ৮ / পংক্তি ২৪-২৫ ও পৃষ্ঠা ৯ পংক্তি ১-২)।
আমরা উনিশ শতকে অনেক ধনী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্ধান পাই। এই নব্য ধনী সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিলেন দেওয়ান বেনিয়ান কিংবা ব্যবসায়ী। এঁদের অনেকেই ধনী এবং দাতা হিসেবে সর্বজনপরিচিত ছিলেন। কিছু কিছু সমাজ সংস্কার ও অন্যান্য সৎকর্মেও এঁরা মুক্ত হস্তে দান করেন। যেমন, শোভাবাজারের দেব পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান নবকৃষ্ণ দেব), খিদিরপুরের ঘোষাল পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান গোকুলচন্দ্র ঘোষাল), আন্দুলের রায় বংশ (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান রামচরণ রায়), জোড়াসাঁকোর সিংহ পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান শান্তিরাম সিংহ, কুমোরটুলীর মিত্র পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান গোবিন্দরাম মিত্র), পাথুরেঘাটার ঠাকুর পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান দর্পনারায়ণ ঠাকুর), বাগবাজারের মুখুজ্যে পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান দুর্গাচরণ মুখোপাধ্যায়), কুমোরটুলীর সরকার পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান বনমালী সরকার), শ্যামবাজারের বসু পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : দেওয়ান কৃষ্ণরাম বসু), রামবাগানের দত্ত পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : বিত্তবান ও বিদ্বান সমাজে প্রতিষ্ঠিত রসময় দত্ত), সিমলের দেব পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : ধনকুবের রামদুলাল দে, নিমতলার মিত্র পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : ব্যবসায়ী গঙ্গাধর মিত্র), কলুটোলার শীল পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : বেনিয়ান ও ব্যবসায়ী মতিলাল শীল), বহুবাজারের মতিলাল পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মতিলাল), ঠনঠনিয়ার ঘোষ পরিবার (প্রতিষ্ঠাতা : ব্যবসায়ী রামগোপাল ঘোষ) ইত্যাদি। আরো কয়েকটি পরিবারও ধনী হিসেবে পরিচিত ছিলেন যেমন, মল্লিক পরিবার, শেঠ পরিবার, বসাক পরিবার, লাহা পরিবার, পালচৌধুরী পরিবার, দেওয়ান সুখময় রায়ের পরিবার, দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহের পরিবার, দেওয়ান রামহরি বিশ্বাসের পরিবার, গঙ্গানারায়ণ সরকারের পরিবার, দেওয়ান কাশীনাথের পরিবার, ব্যবসায়ী মদন দত্তের পরিবার, বেনিয়ান রামচন্দ্র মিত্রের পরিবার প্রভৃতি। কাশীমবাজার রাজপরিবার, জোড়াসাঁকো রাজপরিবার ও পাইকপাড়া রাজপরিবারের নামও এ প্রসঙ্গে করা যায়।