ইদানীং আবার সকলের অনুরোধে গান গাইছেন অমিয়া। গান গাইতে তার ভালই লাগে। এণর মেয়ে কৃষ্ণা থাকেন প্যারিসে। সেবার এসে অমিয়ার কয়েকটা গান নিয়ে গেলেন টেপ করে। বললেন, নিয়ে যাব। ওখানে শোনাব। খালি গলায় গাওয়া, তার বয়স হয়েছে। কি জানি ওদের কেমন লাগবে। সংকোচ যায় না যেন। কৃষ্ণা শুনলেন না। তারপর ফ্রান্স থেকে এলো প্রশংসামুখর চিঠি। ভাষা বোঝে না। তবু অমিয়ার গানের দরদ নাড়া দিল বিদেশীর মনকে। এরপর এলেন সত্যজিৎ রায়। তার কাঞ্চনজঙ্ঘ ছবির জন্যে একটা গান গাইতে হবে। একেবারে খালি গলায়। কারণ ছবিতে ম্যালের এক নির্জন বেঞ্চে বসে গানটিতে ঠোঁট মেলাবেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার রেকর্ডিং করতে হবে? একেবারে ভাল লাগে না অমিয়ার। একবার বলে এটা হয়নি, আবার বলে ওটা হয়নি। ওসব ঝামেলা তার ভাল লাগে না। তাঁর মাসতুতো বোনেরা তো এককালের নামী-দামী অভিনেত্রী লীলা দেশাই ও মণিকা দেশই। তাঁরা বলতেন, তুমি যদি ফিল্মে গান কর অনেক নাম হবে। অনেক টাকা হবে। তাতেই অমিয়া কান দেননি। আর এখন! তবু সবার অনুরোধে গাইতে হল। কাঞ্চনজঙ্ঘার এ পরবাসে রবে কে গান রেকর্ডিং হবার পর দেখা গেল ভালই হয়েছে।
এই সেদিনও, ১৯৭৬ সালে গানের জন্যে তিনি মেডেল পেয়েছেন, কালিদাস নাগ মেমোরিয়াল কমিটি থেকে। এর আগে অবশ্য মেডেল পেয়েছেন অনেকবার সঙ্গীত সংঘ থেকে। বেথুন স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে একটা প্রতিযোগিতায় ধ্রুপদ গেয়ে অমিয় পেয়েছিলেন আশুতোষ মুখোপাধ্যায় গোল্ড মেডেল। মাঝে মাঝে বেশ ভাল অনুষ্ঠানে তার গান শোনা যায়। সম্প্রতি নতুন এল. পি. রেকর্ডে বেরিয়েছে পঞ্চকন্যার গান, তাতে অমিয়া গেয়েছেন দুটি গান বড় বিস্ময় লাগে ও তবু মনে রেখো। এখনো অমিয়ার গান যারা একবার শোনে তারা আবার শুনতে চায়। অমিয়া এসব বিশ্বাস করতে চান না। তাঁর মতে, আজ যারা তার গান শুনতে চায় তারা শুনতে চায় সেযুগের গায়কী বৈশিষ্ট্য, কবির নিজের শেখানো গান। নয়ত এখন কি আর আমার গানে সেই মায়ার খেলার মাকে খুঁজে পাওয়া যায়? অমিয়ার সঙ্গে হয়ত কেউ-ই একমত হবেন না। এখনো তার গলায় মধু ঝরে, সাতটি সুরের পোষা পাখি তান-লয়মীড়ের সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখায়। একজন সাক্ষী উপস্থিত করি। এই সেদিন দেবব্রত বিশ্বাস তার ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত-এ লিখেছিলেন, অমিয়া ঠাকুর বোধহয় তার ৭০ বৎসর পার করে ফেলেছেন। তিনি এখনও গান করেন। এখনও তার গলায় যা স্বাভাবিক কাজ বেরোয় তা স্বরলিপি করা তো দূরের কথা, বর্তমান কালের অথরিটিরা কেউ তা নিজের গলায় গেয়ে দেখাতে পারবেন না। মেনকা অবন ঠাকুরের নাতনী, উমারাণীর একমাত্র মেয়ে। তার বাবা নির্মলচন্দ্রও ছিলেন সঙ্গীতরসিক। ফলে মেয়ে ছোটবেলা থেকেই গানের তামিল নিতে শুরু করেন। এখনকার দিনে এমন উদাত্ত কণ্ঠ বড় বেশি পাওয়া যায় না। গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ওস্তাদ বচ্চন মিশ্রের কাছে গান শেখার পরে বেনারসে একদিন মেনকার গান শোনেন দিনেন্দ্রনাথ। শুনে মুগ্ধ হয়ে মেনকার বাবাকে বলেন, ওকে আমার কাছে দাও—দেখবে এ রত্নকে পালিশ করে কেমন ঝকঝকে করে তুলি। তুলেছিলেন। শেখাবার মতো গলা পেয়ে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন নিজের সমস্ত ঐশ্বর্য। মেনকাও শিখেছিলেন প্রাণভরে। গলা তৈরি হবার পর রেকর্ড বেরোল এসো এসো আমার ঘরে আর শেষ বেলাকার শেষের গানে। দিনেন্দ্রনাথ সঙ্গে বাজালেন এস্রাজ। আর একটা রেকর্ডও হল তোমার বীণা আমার মনোমাঝে ও তোমার সুরের ধারা কিন্তু আর নয়। কারণ এ সময়ে মেনকার বিয়ে হয়ে গেল ক্ষিতীন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্ৰ ক্ষেমেন্দ্রের সঙ্গে। ১১ই মাঘের উৎসবে মেনকার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন ক্ষেমেন্দ্র। তাই গান শেখা বন্ধ হল না। অতি সম্প্রতি পঞ্চকন্যার গানে মেনকা আবার গেয়েছেন সেই পুরনো গানটি এসো, এসো আমার ঘরে।
রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতনে। তার কাছে গান শিখতে না পাওয়ার দুঃখ ঘুচিয়েছিলেন দিনেন্দ্রনাথ। তাই তো দিনেরে অভাবটা বড় বেশি বাজে মেনকার মনে। তাঁর নাম যেন লোকে ভুলেই গেছে। অথচ কবির সকল গানের ভাণ্ডারী ছিলেন তিনি, কাণ্ডারীও। তাকে নিয়ে কেন কিছু হয় না? নিজের গানের স্কুলের নাম দিনেন্দ্র শিক্ষায়তন দিয়ে তিনিই সেই ক্ষোভ। খানিকটা মেটাতে চেয়েছেন। মেনকার গানের স্কুল করাও বেশ মজার ঘটনা। জোড়াসাঁকোয় তারা যেদিকটায় থাকতেন সেখানেই ঠাকুরবাড়ির শেষ সীমানা। ওপাশের বাড়ির একটি মেয়ে সকাল-সন্ধ্যে বেসুরো গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধে। বিরক্ত হয়ে উঠলেন ক্ষেমেন্দ্র। দিনের পর দিন এ নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে স্ত্রীকে অনুরোধ করলেন মেয়েটিকে গান শেখাতে। অর্থাৎ নিজেদের কানের দুঃখমোচনের জন্যেই মেনকাকে গানের ক্লাস খুলতে হল।
তারপর দিনে দিনে বড় হয়েছে তার প্রতিষ্ঠান। তিনিও যুক্ত হয়েছেন বৈতনিক ও পারাণি গানের স্কুলের সঙ্গে। ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেখে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য গীতিকারের গান শেখাতে শুরু করলেন। সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ, সৌম্যেন্দ্রনাথ, স্বর্ণকুমারী, ইন্দিরা, প্রতিভা আরো অনেকেই তো গান লিখেছেন। চর্চা না রাখলে হারিয়ে যাবে যে। জীবনে অনেক সম্মান পেয়েছেন মেনকা। এখন শুধু চান ঠাকুরবাড়ির গানকে অন্যদের গলায় তুলে দিতে। একালে অবশ্য আরো কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ঠাকুরবাড়ির গান প্রচারে উৎসাহী।