হিতেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ অমিয়া ঠাকুর বাড়িতে বৌ হয়ে আসার আগেই সুগায়িকারূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। অমিয়ার বাবা সুরেন্দ্রনাথ রায় ছিলেন সঙ্গীতরসিক। তাই খুব ছোটবেলা থেকেই মুসলমান ওস্তাদের কাছে গান শিখতেন অমিয়া। উদ্ গজল, হিন্দুস্থানী গান—প্রথম প্রথম ভাল লাগত না কিন্তু গলা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আজও শুনলে প্রাণে বাজে। একবার শুনলে মনে হয় আবার শুনি। অমিয়াকে ঠাকুরবাড়িতে এনেছিলেন হেমেন্দ্রনাথের মেয়ে মনীষা। সরলা তখন মায়ার খেলার অভিনয়ের জন্যে মেয়ে খুঁজছেন। ভারী পছন্দ হয়ে গেল অমিয়াকে। প্রমদার ভূমিকায় সুন্দর মানাবে। যেমন রূপ তেমনি গলা। খুব ছোট থেকেই অভিনয় করছেন অমিয়া। বাল্মীকিপ্রতিভায় কখনও বালিকা সাজছেন কখনও সরস্বতী। বেথুনে পড়তেন অমিয়া। সেখানে স্কুল-কলেজের মেয়েরা মাঝে মাঝে নাট্যাভিনয় করত। সবেতেই অংশ নিতেন তিনিচন্দ্রগুপ্তে হেলেন, নূরজাহানে নূরজাহান। বাংলা দেশে তখন দ্বিজেন্দ্রলালের যুগ চলছে। সরলা দুদিনে অমিয়াকে প্রমদার সব গান শিখিয়ে নিয়ে গেলেন কবির কাছে। দুরুদুরু বুকে কবির কাছে এসে দাঁড়ালেন অমিয়া। তবে তিনি নিজেকে যতটা অপরিচিত ভাবছিলেন, তা নয়। কবি তার নাম আগেই –শুনেছিলেন স্নেহলতা সেনের কাছে। ১৩২৯ সালে প্রশান্ত মহলানবীশকে লেখা চিঠিতেও দেখা যাবে তিনি লিখছেন, বেথুন কলেজে অমিয়া রায় বলে একটি মেয়ে আছে; তার গলা ঝুনুর চেয়েও ভাল। সুতরাং কোন অসুবিধে হল না। সরলা কবিকে বললেন, অমিয়াকে প্রমদার গানগুলো সব শিখিয়ে দিয়েছি, তুমি গানগুলোর সঙ্গে অ্যাকশন দেখিয়ে দাও। রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কী? এর মধ্যেই সব গান তোলা হয়ে গেল! সরলা খুব জোরের সঙ্গেই বললেন, হ্যাঁ, ওর সব গানই ভোলা হয়ে গেছে! তুমি অ্যাকশন দেখিয়ে দাও। কবি তখন খুব ব্যস্ত তবু অনিন্দ্যসুন্দর ভঙ্গিতে নেচে নেচে অমিয়াকে শিখিয়ে দিলেন দে লো সখি দে, বলে রেখে দে, কে ডাকে আমি কভু ফিরে নাহি চাই, ওকে বলো সখি বলো, দূরে দাঁড়ায়ে আছে, আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, আর কেন আর কেন গান। এবার অবাক হবার পালা অমিয়ার। কী সুন্দর কোমল রমণীয় ভঙ্গি! দীর্ঘদিন রিহার্সাল চলার পর রক্সি সিনেমা হলে যে সেই মায়ার খেলার অভিনয় দেখেছে সেই শুধু বলতে পারে কি সুন্দর অভিনয় হয়েছিল। শান্তা সেজেছিলেন রুমা গুহের মা সতী দেবী। অমর সেজেছিলেন শান্তি দত্ত। কুমার বোধহয় সুধীন্দ্রনাথের মেয়ে রমা। মায়াকুমারীদের দলে ছিলেন রেবা রায়, জয় দাশ, মায়া রায়, সুমনা সেন, গৌরী দাশ। প্রধান মায়াকুমারী সেজেছিলেন রেবা রায়। সবাইকে সাজিয়ে দিয়েছিলেন কবির পুত্রবধূ প্রতিমা; শাড়ি পরিয়ে দিলেন পারুল ঠাকুর আর সুজাত। সবার অভিনয় ছাপিয়ে চোখে পড়েছিল প্রমদাকে। মায়ার খেলার প্রথম প্রমদা—ইন্দিরা তো ভারি খুশি, এমনটি বুঝি আর দেখা যায় না।
এরপর বৌ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে এলেন অমিয়া। নিভৃতে সবার চোখের আড়ালে চলে সঙ্গীত সাধনা। আগে শিখেছিলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও যোগীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। এবার শিখলেন দিনেন্দ্রনাথ ও ইন্দিরার কাছে। কবি যখন শান্তিনিকেতন থেকে আসতেন ডেকে পাঠাতেন অমিয়াকে! গান শুনতেন, শেখাতেন—এভাবেই অনেক কিছু শেখা হয়ে গেল। কবির সত্তর বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রথম প্রকাশ্যে গান করলেন অমিয়া। এ ব্যাপারে তার স্বামী বিশেষ আগ্রহ দেখাননি বলে অমিয়া আড়ালে থাকতেই ভালবাসতেন। অবশ্য গান শেখায় তিনি বাধা দেননি বরং উৎসাহই দিয়েছেন। য়ুনিভারসিটি ইন্সটিটিউট হলে অমিয়া প্রথমদিন গাইলেন মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে। শিখেছিলেন কবির কাছেই। আরো শিখেছিলেন কী রাগিনী বাজালে, বড় বিস্ময় লাগে, ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ, আকুল কেশে আসে প্রভৃতি। অনুষ্ঠানে সঙ্গে এস্রাজ বাজালেন দিনেন্দ্রনাথ। সবাই। চিত্রার্পিত। এমন মধুর সাবলীল কণ্ঠ! যেন পাখির মতে! সুধীন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে এ কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, সেকালে তিনি অন্যদের মুখে শুনেছিলেন অমিয়ার গলা নাকি অভিজ্ঞার কণ্ঠের মতো সুন্দর কিন্তু তিনি নিজে তো আর অভিজ্ঞার গান শোনেননি তাই তুলনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথেয় খুব ভাল লেগেছিল অমিয়ার গান; তাই পরদিন আবার শুনতে চাইলেন। দ্বিতীয় দিন অমিয় গাইলেন ওগো কাঙ্গাল আমারে কাঙ্গাল করেছ।
এরপর যখনই কোথাও গিয়েছেন তখনই লোকে অমিয়ার কণ্ঠে শুনতে চেয়েছেন মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী উৎসব পরিষৎ-এর তরফ থেকে যখন শাপমোচন আর নটীর পূজা অভিনয়ের আয়োজন হয়েছিল তখন অমিয়াকে শচীর ভূমিকায় অভিনয় অভ্যাস করলেন দিনেন্দ্রনাথ। কবি স্বয়ং বললেন, অমিয়া সখি এ আঁধারে একেলা। ঘরে গাইবে। সম্প্রতি প্রকাশিত অমিয়ার স্মৃতিকথা কী ধ্বনি বাজে পড়লে। আরো অনেক কথা জানা যায়। তিনি বলেছেন, শেষ বয়স পর্যন্ত রবিদাদার সমান আগ্রহ ছিল হিন্দী গান শেখার। বলে বোলে যাওরে ভৈরবী সুরের গান শুনতে খুব ভালবাসতেন অথচ সেই গানটা ভেঙে কবি বাংলা গান লিখেছেন বলে জানি না। ভাঙা গান তৈরি করায় তার গুণপনার কথা আজ কারও অজানা নয়। কিন্তু আমার গলায় শুনে একটি হিন্দী গান ভেঙে বাংলা গান তৈরি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি। রবীন্দ্রনাথ অমিয়ার কণ্ঠে পূরবীতে এ ধনি ধ্বনি চরণ পরসত খেয়াল গানটা শুনে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বাংলা গান তৈরি করে ফেললেন, সেই অসাধারণ গানটি হল কী ধ্বনি বাজে গহন চেতনা মাঝে। তাই অমিয়ার স্মৃতিকথার নামও কী ধ্বনি বাজে। একটা রেকর্ডও করেছিলেন অমিয়া। শৈলজারঞ্জন মজুমদার খুব যত্নে শিখিয়েছিলেন হে নূতন দেখা দিক ও সমুখে শান্তি পারাবার। কিন্তু স্বামীর অকালমৃত্যু হবার পর ছেলেমেয়েদের মানুষ করা, উড়িষ্যায় নিজেদের জমিদারী দেখাশোনা করার কাজেই ব্যস্ত ছিলেন অমিয়া। তারই মাঝে মাঝে গান শিখতে বা বুঝে নিতে এসেছে কেউ কেউ—শিখিয়ে দিয়েছেন তাদের। গানের ক্লাস নিয়ে নয়, গান শুনিয়ে। স্বরলিপি দেখে নয়, অমিয়া গান শিখতেন শুনে। কটকেও বোধহয় বর্ষামঙ্গল বা এইরকম আরো কয়েকটা অনুষ্ঠানে তিনি মেয়েদের গান শিখিয়েছিলেন।